বাংলাদেশের বাঁশির সুর বিদেশেও

শ্রীমদ্দী গ্রামে একটু কান পাতলেই শোনা যায় বাঁশির সুর। গ্রামটিতে বাঁশির সুলুক সন্ধানে এক শতাব্দীরও বেশি পেছনে ফিরতে হয়। দুইজন বাঁশি তৈরির কারিগর কোকিল দাশ বৈরাগী ও দীনবন্ধু ভারত থেকে সেখানে গিয়েছিলেন বাঁশি ব্যবসা করতে। যতদিন সেখানে ছিলেন বাঁশি তৈরি করে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাঁরা বিক্রি করেছিলেন। এই গল্প এখনও ওই এলাকার মানুষের মুখে মুখে। তাঁরা যে কারিগরির গোড়াপত্তন করে দিয়ে যান সময়ের সাথে তা শুধু টিকেই থাকেনি, কুমিল্লার হোমনার এই বাঁশি এখন ২৫টি দেশে রপ্তানিও হচ্ছে।
শ্রীমদ্দী গ্রামে বাঁশি তৈরির কাজ করছেন রিনা বিশ্বাস। ছবি: মাসুক হৃদয়

শ্রীমদ্দী গ্রামে একটু কান পাতলেই শোনা যায় বাঁশির সুর। গ্রামটিতে বাঁশির সুলুক সন্ধানে এক শতাব্দীরও বেশি পেছনে ফিরতে হয়। দুইজন বাঁশি তৈরির কারিগর কোকিল দাশ বৈরাগী ও দীনবন্ধু ভারত থেকে সেখানে গিয়েছিলেন বাঁশি ব্যবসা করতে। যতদিন সেখানে ছিলেন বাঁশি তৈরি করে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাঁরা বিক্রি করেছিলেন। এই গল্প এখনও ওই এলাকার মানুষের মুখে মুখে। তাঁরা যে কারিগরির গোড়াপত্তন করে দিয়ে যান সময়ের সাথে তা শুধু টিকেই থাকেনি, কুমিল্লার হোমনার এই বাঁশি এখন ২৫টি দেশে রপ্তানিও হচ্ছে।

বাঁশি তৈরি শুরুর দিকের কথা জানতে কথা হয় স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি রুই দাশের সাথে। তিনি বলেন, “কোকিল ও দীনকে অনুসরণ করেই আমাদের বাঁশি তৈরির ঐতিহ্য।” গত ১২০ বছরের বেশি সময় ধরে অন্তত ৪০টি পরিবার বাঁশি বানাচ্ছে বলে তিনি জানান। এই গ্রামে বয়স্ক থেকে শুরু করে স্কুল শিক্ষার্থী সবার অবসর কাটে বাঁশি তৈরি করে। আর বাঁশির ছিদ্র তৈরি, ধোয়া, শুকানো আর রঙ করার দায়িত্ব থাকে মেয়েদের ওপর।

ছবি: মাসুক হৃদয়

বাঁশির বাজার নিয়েও কথা বলেন রুই দাশ। তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর বাঁশির বাজার ভালো ছিলো। চৈত্র মাসে ঢাকার চকবাজার থেকে বাঁশির পাইকারি ক্রেতারা আসতো। এক সাথে তাঁরা দেড় লাখ পর্যন্ত বাঁশি কিনতো। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা থেকে শুরু করে অন্যান্য জায়গার বাঁশি ব্যবসায়ীরাও চিঠি দিয়ে চাহিদা জানাতো। সে অনুযায়ী বাঁশি তৈরি করে লঞ্চ ও ট্রেনে করে পাঠানো হতো।”

প্রতিবেশী নির্জন চন্দ্র সরকারও বাঁশি তৈরি করেন। বাঁশি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেনে, আমরা মুলি বাঁশ ব্যবহার করি। বাঁশির দৈর্ঘ্য ২০ ইঞ্চির আশপাশে হয়। তিন থেকে সাতটি ছিদ্র থাকে প্রতিটিতে। টোটা, মুখ, আড়, ভীন, বেলুন, ক্লাসিক্যাল, খানদানী, মোহন ও প্রাকৃতিক এমন আট ধরনের বাঁশি তৈরি হয় এখানে।

ছবি: মাসুক হৃদয়

আরেকজন বাঁশির কারিগর অনিল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, “বাঁশি বানাতে আমরা প্রথমে বাঁশ কেটে শুকাই। পরে বাঁশ ছিলে ফেলা হয়। কাদামাটি দিয়ে বাঁশির ওপর নকশা করে হালকাভাবে পোড়ানো হয়। কাদা ঝড়ে গেলে নকশা ফুটে ওঠে। এর পর মাপ অনুযায়ী ছিদ্রগুলো পেন্সিলের দাগে চিহ্নিত করে সূচালো লোহার রড দিয়ে ফুটো করা হয়। বাঁশিগুলো ধোয়ার পর প্যাকেটে সরবরাহ করা হয়।”

গাজীপুরের বাঁশি ক্রেতা নিহার সরকার গত ৪০ বছর থেকে হোমনা থেকে বাঁশি কিনছেন। তিনি বলেন, “শিশু ও কমবয়সীদের কাছে বাঁশির জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি।” প্লাস্টিকের খেলনার প্রসার নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি। তাঁর মতে বাঁশির চাহিদা কমে যাওয়ার পেছনে প্লাস্টিকের খেলনা দায়ী। ভিডিও গেমের জনপ্রিয়তার কারণেও তরুণরা বাঁশি বিমুখ হচ্ছেন বলে তিনি মনে করেন।

ছবি: মাসুক হৃদয়

এত কিছুর পরও বিদেশে বাঁশির জনপ্রিয়তায় সুদিনের স্বপ্ন দেখছেন এখানকার বাঁশির কারিগররা। বিদেশি ক্রেতারা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাঁশির চাহিদা জানাচ্ছেন। এমনই একজন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বাঁশি ব্যবসায়ী সুব্রত সাহা। তিনি বলেন, “প্রতি বছর আমি বিদেশ থেকে বাঁশির অর্ডার পাই। বিদেশ থেকেই তাঁরা নমুনাসহ বাঁশির চাহিদা জানিয়ে দেন।”

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জন্য কুমিল্লার এই গ্রামে এখন প্রতি বছর প্রায় এক কোটি বাঁশি তৈরি করা হচ্ছে।

Click here to read the English version of this news

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago