বাংলাদেশে ফিরতে চায় ভারতে যাওয়া ২০৬ জন ছিটমহলবাসী

বাংলাদেশ থেকে ভারতের মূল-ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়া লালমনিরহাটের পাটগ্রাম ও হাতিবান্ধার বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলের ২০৬ বাসিন্দা আবার বাংলাদেশেই ফিরতে চাইছেন। মৌলিক অধিকারও পূরণ হবে না এমন স্থায়ী ক্যাম্পে তাদেরকে পুনর্বাসনের প্রতিবাদে তারা এই সিদ্ধান্তও নিতে যাচ্ছেন। এমন কি তারা আজ (৩১ জুলাই) মধ্যরাতের ছিটমহল বিনিময় দিবসও বয়টক করেছেন।

বাংলাদেশ থেকে ভারতের মূল-ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়া লালমনিরহাটের পাটগ্রাম ও হাতিবান্ধার বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলের ২০৬ বাসিন্দা আবার বাংলাদেশেই ফিরতে চাইছেন। মৌলিক অধিকারও পূরণ হবে না এমন স্থায়ী ক্যাম্পে তাদেরকে পুনর্বাসনের প্রতিবাদে তারা এই সিদ্ধান্তও নিতে যাচ্ছেন। এমন কি তারা আজ (৩১ জুলাই) মধ্যরাতের ছিটমহল বিনিময় দিবসও বয়টক করেছেন।

২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহল দুই দেশের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে মিশে গিয়েছিল। আর এর মধ্যেই দুই দেশের ছিটমহলের ভেতরের বাসিন্দারা নিজভূমি বদলের সুযোগ পেয়েছিলেন।

সেই সুযোগ পেয়েই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন বাসিন্দার মধ্যে ৯২১ জন (২০১৫ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর কয়েক দফায়) ভারতের মূল-ভূখণ্ডে ফিরে গেলেও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটের ১৪ হাজার ২১৫ জন ভারতীয় হিসেবেই থেকে যান।

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ৯২১ জন ভারতীয় ছিটের বাসিন্দাকে কোচবিহার জেলার দিনহাটা, হলদিবাড়ি ও মেখলীগঞ্জ তিনটি অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।

দিনহাটা-হলদিবাড়ি নিয়ে তেমন গুরুত্বর অভিযোগ না উঠলেও মেখলীগঞ্জ অস্থায়ী ক্যাম্প নিয়েই শুরু থেকে নানা ধরণের অভিযোগ তুলছেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ভারতীয় উদ্বাস্তুরা।

বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া ৯২১ জনের মধ্যে ৫০০ জন কোচবিহার জেলার হলদিবাড়িতে অস্থায়ী এই ক্যাম্পে রয়েছেন। ছবি: স্টার

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেখলীগঞ্জের বর্তমান অস্থায়ী শিবির থেকে নতুন স্থায়ী পুনর্বাসন কেন্দ্রের জায়গা নিয়েই তীব্র আপত্তি আগতদের। মেখলীগঞ্জের ভোটবাড়ি অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে ধরলা নদী তীরবর্তী পানিশালা এলাকায় বিলুপ্ত ছিটের মানুষের জন্য স্থায়ী পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরির কাজ চলছে।

নতুন পুনর্বাসন কেন্দ্রে মৌলিক অধিকার পূরণেরও কোন সুযোগ নেই- এমন অভিযোগ তুলে সম্প্রতি ২০৬ জন বাসিন্দা অন্যত্র পূনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করে স্থানান্তর অথবা তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আল্টিমেটাম দিয়েছেন।

লিখিত ওই অভিযোগে বলা হয়, “প্রথমত পানিশালায় যে পুনর্বাসন কেন্দ্র করা হয়েছে সেটা স্বাস্থ্য সম্মত নয়। সেখান থেকে স্কুল, কলেজ এবং হাসপাতাল ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে। স্বাভাবিক চলাফেরার রাস্তাও নেই। এমনকি একজন গর্ভবতী নারীকে প্রসব করাতে ২০ কিলোমিটার দূরের উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। তাই পানিশালা পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০৬ জনের কেউ যেতে ইচ্ছুক নন। প্রয়োজনে তাদের সবাইকে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক।”

মেখলীগঞ্জ ভোটবাড়ি এনক্লেভ সেটেলম্যান্ট কমিটি নামে ইতিমধ্যে তারা একটি সংগঠনও তৈরি করেছে। ওই কমিটির ব্যানারে ২৬ জুলাই কোচবিহারের জেলা শাসক কৌশিক সাহার কাছে ওই লিখিত দাবি তুলে দেওয়া হয়। এর আগে ১৪ জুন থেকে ১৭ জুন টানা চার দিন মেখলীগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের অফিসের সামনেও অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন। প্রয়োজনে তারা আরও বড় আন্দোলনে নামতে প্রস্তুত। মেখলীগঞ্জ ভোটবাড়ি অস্থায়ী শিবির থেকে টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে এমন তথ্যই জানালেন বিপুল রায় নামে বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতীয় আন্দোলনকারী।

তিনি আরও জানান, “লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম ও হাতিবন্ধা উপজেলা এলাকার ভারতীয় ছিটমহলের ৪৭ পরিবারের ২০৬ জন মানুষ মেখলীগঞ্জের অস্থায়ী শিবিরে আশ্রিত রয়েছেন। হলদিবাড়ি ও দিনহাটার বাকি দুটি অস্থায়ী ক্যাম্পে বাংলাদেশ থেকে আসা বাকি ভারতীয় ছিটবাসীদের তুলনায় মেখলীগঞ্জের আশ্রিতদের অবস্থা করুণ।”

মৌলিক সুযোগ সুবিধার দাবিতে মেখলীগঞ্জের অস্থায়ী ক্যাম্পে ছিটমহলের আন্দোলনকারী এক নারীকে এভাবেই পাজাকোলে করে অ্যাম্বুলেন্স-এ তোলা হয়। ছবি: স্টার

মেখলীগঞ্জের অস্থায়ী ক্যাম্প নিয়ে চলমান অবস্থা উত্তরণে তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া বামফ্রন্ট, বিজেপির মতো রাজনৈতিক দলগুলোও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সহমত জানিয়েছে। আর সে কারণেই বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বামফ্রন্টরে স্থানীয় নেতা এবং প্রাক্তন মন্ত্রী পরশে চন্দ্র অধিকারী জানিয়েছেনে, কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারই এই ছটিমহলবাসীদরে নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছে। বাস্তবে এই মানুষগুলো ৬৮ বছররে মতোই এখনও পরাধীন।

বিজেপির মেখলিগঞ্জ দক্ষিণ মণ্ডলের সভাপতি দধিরাম রায় জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা স্বত্বেও তৃণমূলের রাজ্য সরকার বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষগুলোর সুবিধা নিশ্চিত করেনি। ভোটের হিসাব ছাড়া তৃণমূল আর কিছুই বোঝে না। তাই ভোটের আগে ছিটমহলগুলোতে নেতা-নেত্রীর ভিড় লেগে গেলেও ভোট শেষে তাদের কেউ এই মানুষগুলোর মানবেতর জীবন দেখতে আসছেন না।

এই ব্যাপারে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা তপন কুমার দে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হন। তবে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতীয় ছিটমহলবাসীদের দাবির পক্ষে যুক্তি দেখছেন। তাদের মত হচ্ছে, মানুষের থাকার উপযোগী একটি এলাকায় স্থায়ী ক্যাম্প করার উদ্যোগ নেওয়াই যেতো।

প্রশাসন সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প হলেও স্থানীয়ভাবে রাজ্য সরকারের প্রশাসনের পরিকল্পনা অনুযায়ী এইসব ক্যাম্পের জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনকি ক্যাম্পে তৈরিতে বরাদ্দও পর্যন্ত শাসক দল তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের দেওয়া হয়েছে।

এই ব্যাপারে কথা বলতে কোচবিহারের জেলা শাসক কৌশিক সাহার অফিসে ফোন করা হলে তার ব্যক্তিগত সচিব জানান তিনি অফিসে নেই। এরপর তার মোবাইল ফোনে ফোন করা হলেও ফোন বেজে গিয়েছে, কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

তবে জেলা শাসক অফিস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান জেলা শাসক মাত্র দুই মাস হল কোচবিহারে দায়িত্ব নিয়েছেন। এর আগে পি ওলাঙ্গানাথন ছিলেন জেলাশাসক। মূলত তার প্রশাসনই ছিটমহল বিলুপ্ত হওয়ার যাবতীয় কাজ করে গিয়েছে। ফলে নতুন জেলা শাসকের পক্ষে এই মুহূর্তে সবকিছু বলা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া ছিটমহলবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবার রয়েছে হলদিবাড়ি অস্থায়ী ক্যাম্পে। সেখানে রয়েছেন ৯৬ পরিবারের ৫০০ সদস্য। দিনাহাটায় রয়েছেন ৫৬ পরিবার। এক থেকে পাঁচ সদস্য আছেন এমন পরিবার প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল, পাঁচ কেজি ডাল, সাত লিটার কেরোসিন তেল, দুই কেজি লবণ, এক কেজি গুড়োদুধের প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে অতিরিক্ত একজনের জন্য সব হিসাবের আধা কেজি করে বাড়তি দেওয়া হচ্ছে।

হলদিবাড়ি অস্থায়ী ক্যাম্পের বাসিন্দা অশ্বিনী কুমার রায় জানালেন, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার একনম্বর দহলাখাগড়াবাড়ি ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দা তার পরিবার। দেবীগঞ্জ স্কুল-কলেজে পড়াশোনা শেষ হয়েছে তার। এখন হলদিবাড়ি কলেজে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়ছেন। থাকার এই ক্যাম্প আর সরকারি রেশন সুবিধা ছাড়া তেমন কোনও সুবিধা তারা এখনও পাচ্ছেন না বলে জানান ওই তরুণ।

একই অবস্থা দিনহাটার কৃষিমেলা মাঠের অস্থায়ী ক্যাম্পেও। সেখানে ৫৮ জন আশ্রয় পেয়েছেন। ওই ক্যাম্পের বাসিন্দা ওসমান গনি জানালেন, ভারতের এসে এই অবস্থা হবে সেটা জানলে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশেই থেকে যেতাম। দিনহাটার অস্থায়ী ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বড় সমস্যা বলেও দাবি করেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ভারতীয় বিলুপ্ত ছিটমহলের ওই বাসিন্দা।

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago