বিচারপতি খায়রুল হকের বক্তব্যে কার লাভ, কার ক্ষতি?

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী?
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায় সর্বসম্মত। মানে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতি ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এ রায় দিয়েছেন। কিন্তু আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে খায়রুল হক এ রায়কে “অগণতান্ত্রিক” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ২০১১ সালে আপিল বিভাগ ১৩তম সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক এবং বাতিল বলে ঘোষণা করে। মূল রায় তিনি লেখেন। তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেন তিনজন। বাকি তিনজন দ্বিমত পোষণ করেন এবং তাঁরা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দেন।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়কে যিনি অগণতান্ত্রিক বলছেন, তিনি কি বলবেন ১৩তম সংশোধনী বাতিল রায়ের গণতান্ত্রিক চরিত্রটা কেমন?
সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী বাতিল রায়ে তিনি “উদ্ভট” একটি সুপারিশ করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক এবং বাতিল বলে ঘোষণা করেও সেটিকে আরও দশ বছর বাঁচিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। যাতে দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে।
তাঁর এমন পরামর্শ সে সময়কার সরকার এবং জাতীয় সংসদ আমলে নেয়নি। বরং এ পরামর্শকে “উদ্ভট” হিসেবে আখ্যা দেয়। ২০১১ সালের মে মাসে সে সময়ের প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ১৩তম সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক এবং বাতিল বলে ঘোষণা করেন। পরের মাসেই ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করা হয়। খায়রুল হকের পূর্ণ রায়ের প্রতি মানুষের আর কোন আগ্রহ থাকেনি। প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর ২০১৩ সালের নভেম্বরে পূর্ণ রায় প্রকাশিত হয়। অবসরে যাওয়ার এতোদিন পর কোন রায়ে স্বাক্ষর করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল তখন।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়কে সমালোচনা করতে খায়রুল হক সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা শুধু অযৌক্তিক নয়, হাস্যকরও বটে। তিনি দাবি করেছেন ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে এমপিরা সংসদে দায়িত্ব পালনে কোন বাধার সম্মুখীন হোন না। তাঁরা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন বলে খায়রুল হক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এক দশক আগে তিনি যখন হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন তখন এক রায়ে মতামত দেন যে, ৭০ অনুচ্ছেদের বিধিনিষেধ এমপিদেরকে দলের বন্দিতে পরিণত করেছে।
বর্তমান সংসদ খুব কার্যকর বলে তিনি যে দাবি করেছেন এমন দাবি সরকার দলের কোন এমপি বা মন্ত্রীও সহজে করবেন না। বর্তমান সংসদকে সমর্থন করে যুক্তি দাঁড় করানো কী তিনি তাঁর নৈতিক দায়িত্ব মনে করেন?
১৩তম সংশোধনীর রায়ে তিনি বলেন যে, “অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিঃসন্দেহে সংবিধানের একটি Basic structure (মৌলিক কাঠামো)।” তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। বড় একটি রাজনৈতিক দলসহ অধিকাংশ দল সে সময়ের সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় একতরফা নির্বাচন, যাতে রেকর্ড সংখ্যক ১৫৩ জন এমপি বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে যান। বাকি ১৪৭ আসনে ভোট গ্রহণ ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ উপহার দেওয় আরও বিস্ময়। প্রধান বিরোধী দলের কয়েকজন এমপিকে মন্ত্রী বানানো হয়। তা না হলে তাঁরা বিরোধী দলের বেঞ্চে বসতে নারাজ। প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে বানান হয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। খোদ বিরোধী দলের সদস্যরাই নানা সময়ে তাঁদের পরিচয় সংকটের কথা বলেছেন। একটি ভালো নির্বাচন না হওয়াতেই এমন একটি সংসদ সম্ভব হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যদি সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো হয়ে থাকে তাহলে গত নির্বাচন কি সংবিধানের সেই মৌলিক কাঠামোতে আঘাত করেনি? আশা করি, বিচারপতি খায়রুল হক কোন একদিন এ প্রশ্নের জবাব দিবেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের লেখা ১৩তম সংশোধনীর রায়ের কিছু লাইন উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, “কোন রায়ই প্রধান বিচারপতি একক সিদ্ধান্তে প্রদান করেন না, কিন্তু সেই রায় যদি কোন রাজনৈতিক দলের স্বার্থের বিপক্ষে যায় তাহা হইলে আদালত ও আদালত প্রাঙ্গণে উক্ত রাজনৈতিক দলের সমর্থক আইনজীবীগণ প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেন।”
বাস্তবে কী ঘটলো। রাজনৈতিক দলের সমর্থক আইনজীবীগণ যতোটা না আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তার চেয়ে বহুগুণ আলোড়ন সৃষ্টি করলেন বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করে। যে ভাষায় সমালোচনা করেছেন তেমন “জ্বালাময়ী” ভাষা কোন রাজনৈতিক নেতা এখন পর্যন্ত ব্যবহার করেননি। প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা সেসব ভাষা আর পুনর্মুদ্রণ করতে চাই না। তাঁর বক্তব্য আদালত অবমাননার শামিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিচারপতি খায়রুল হক এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। যেসব ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং যে কতিপয় উদ্ভট ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে এই রায়ের বিরোধিতাকারীরা সন্তুষ্ট হতে পারেন। কিন্তু নিজেকে এমন স্তরে নামিয়ে আনলেন যা অনেকেই কল্পনাও করতে পারেননি। অতীতে যারা প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাঁদের কেউ এমন নজীর স্থাপন করেননি।
আইন কমিশনের প্রধান হয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি শুধু নীতি-নৈতিকতা বিরুদ্ধ কাজ করার দায়ে নয়, আইন কমিশনের আইন লঙ্ঘনের দায়েও অভিযুক্ত হতে পারেন। কেননা, ১৯৯৬ সালের আইন কমিশনের আইনে কমিশনের যেসব কাজ করার কথা সেসবের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন ডেকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেওয়ার কোন কাজ তাঁকে বা কমিশনকে দেওয়া হয়নি। এমন কাজ তাঁর এখতিয়ার বহির্ভূত। সাবেক প্রধান বিচারপতি আশা করি ভেবে দেখবেন তাঁর বক্তব্যে কে বা কারা কতোটুকু লাভবান হলেন, কার কতোটুকু ক্ষতি হলো।
Comments