‘বিদ্রোহী’ কবিতার আঁতুড়ঘর
কলকাতার তালতলা লেনের ৩/৪ সি বাড়িটি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার আঁতুড়ঘর। ১৯২১ সালে দ্বিতল এই বাড়িটিতে বসে কবি লিখেছিলেন রক্তে দোলা জাগানিয়া ‘বল বীর.. চীর উন্নত মম শির।’
কবিতার প্রতিটি পঙক্তি যেন শরীরের রক্ত শুদ্ধ করে আওয়াজ তোলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বিদ্রোহের দামামা বাজায় প্রতি মুহূর্তে, আজও এই কবিতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কোনও বিতর্ক নেই।
-আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি/আমি পথ-সমুখে যাহা পাই; যাই চূর্ণি/ আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ/ আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ/ আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল/ আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি ছমকি/পথে যেতে যেতে চকিত চমকি-
বিদ্রোহী কবিতা রচনাকাল এবং সময় নিয়ে যদিও বিস্তর বিতর্ক আছে। কিংবা বিদ্রোহী কবিতা প্রথম কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল সে বিষয়েও দ্বন্দ্ব আছে আজও।
তবে বিতর্ক যাই থাকুক, কলকাতার তলতলা লেনের ৩/৪সি লেনের বাড়িটির কোন এক অন্ধকার ঘরে লন্ঠন জ্বালিয়ে কবি তাঁর চিন্তার ভ্রূণ কলমের কালির মধ্যদিয়ে সাদা পৃষ্ঠায় ঢেলে গিয়েছিলেন, বর্ণমালায় একে একে গেঁথে গিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবিতা- সেটা নিয়ে বিতর্কে অংশ নেওয়া নজরুল ইসলামের সমসাময়িক প্রায় সবাই একমত রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নজরুল গবেষক আহমদ কবিরের একটি প্রবন্ধে বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া গিয়েছে ২০১১ সালে। প্রথম আলো’তে প্রকাশিত ওই লেখার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য হুবুহু তুলে দেওয়া হলো এখানে...
“মুজফফর আহমদের দেওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেন বাড়িতে রচিত হয়েছিল। ১৯২০ সালে ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টন ভেঙে গেলে নজরুল প্রথমে তাঁর সতীর্থ কথাসাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাসায় ওঠেন, সেখানে কয়েক দিন থেকে আরেকটি বাসস্থানে, পরে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে উঠলেন। সেখানে তাঁর বন্ধু মুজফফর আহমদ থাকেন। তাঁর সঙ্গে নজরুল একত্র বসবাস করেছেন আরও কয়েকটি বাসায়, শেষে ৩/৪ সি তালতলা লেনে। মুজফফর আহমদ স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, পুরো বাড়ি পশ্চিমগাঁর নওয়াব ফয়জুন্নিসা চৌধুরানীর নাতিরা ভাড়া নিয়েছিল। বাড়ির নিচতলার দক্ষিণ-পূর্ব ঘরটি নজরুল ও মুজফফর আহমদ ভাড়া নিয়েছিলেন।
কবিতাটি কোথায়, কখন রচিত হয়েছিল সে প্রসঙ্গে মুজফফর আহমেদ লিখেছেন, ‘এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতা লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত ১০টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। “বিদ্রোহী” কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।’ মুজফফর আহমদ জানিয়েছেন, নিজের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই কবিতাটি শুনে তিনি কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি। এতে নজরুল মনে মনে আহত হয়েছেন নিশ্চয়ই। কবিতাটির রচনার সময় নিয়ে মুজফফর আহমদ আবার বলেছেন, ‘আমার মনে হয় নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। তাঁর ঘুম সাধারণত দেরীতেই ভাঙত, আমার মতো তাড়াতাড়ি তাঁর খুব ভাঙত না।’ মুজফফর আহমদ আরও জানিয়েছেন, নজরুল সম্ভবত প্রথমে কবিতাটি পেনসিলে লিখেছিলেন।
আহমদ কবির আরো লিখেন... ‘বিদ্রোহী’ কোন পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়েছিল সে নিয়েও বিতর্ক আছে। নজরুল রচনাবলীর (বাংলা একাডেমি) সম্পাদক আবদুল কাদির প্রথম খণ্ডের গ্রন্থ পরিচয়ে জানিয়েছেন, ‘বিদ্রোহী ১৩২৮ কার্তিকে ২য় বর্ষের ৩য় সংখ্যক ‘মোসলেম ভারত’-এ বাহির হইয়াছিল। ১৩২৮ সালের ২২শে পৌষের সাপ্তাহিক বিজলীতে এবং ১৩২৮ মাঘের প্রবাসীতে উহা সংকলিত হইয়াছিল।’ আবদুল কাদির এ তথ্যও জানিয়েছেন যে ‘মোসলেম ভারতে’ প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আরও কয়েকটি চরণ ছিল, যেগুলো পরে পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু মুজফফর আহমদ বলেছেন, ‘বিদ্রোহী’ প্রথমে সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় ছাপা হয়েছে (১৯২১ সালের ৬ জানুয়ারি, ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) মুজফফর আহমদের কথায়, ‘‘বিদ্রোহী’ প্রথম ছাপানোর সম্মান বিজলীরই প্রাপ্য।’ এ কথা অবশ্য ঠিক যে ‘মোসলেম ভারতে’ প্রকাশের জন্য নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পাদক আফজালুল হককে প্রথমে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘মোসলেম ভারতে’র কথিত সংখ্যাটি বের হতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।’
তলতলার বাড়িতে আজ ২৫ মে নজরুল শতবর্ষ উদযাপন কমিটির উদ্যোগে স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন ছাড়া সারা বছর বাড়িটির নিয়ে তেমন কোনও হৈচৈ থাকে না এমন কি নজরুল ভক্ত-গবেষক ছাড়া কোনও দর্শনার্থীর পা-ও পড়ে না ঐতিহাসিক এই বাড়িটির চৌহদ্দিতে।
শতবর্ষ উদযাপন কমিটির সদস্য মুকুলকৃষ্ণ চ্যাটার্জি এই প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারকে বললেন, ‘বহু চেষ্টা করেও এই বাড়িটি হেরিটেজ ভবন করা সম্ভব হয়নি। কলকাতা পৌরসভার কাছে বহু আবেদন করা হয়েছে- বিদ্রোহী কবিতার আঁতুড়ঘরকে জাদুঘর হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু কাজ হয়নি।’
আর কলকাতা পৌরসভার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বহু চেষ্টা করেও এই বিষয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
Comments