‘মওদুদের বাড়ি’: প্রেম ও প্রতারণার গল্প

গুলশান অ্যাভিনিউয়ের যে বাড়ি থেকে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে সম্প্রতি উচ্ছেদ করা হয়েছে, সেই বাড়িটি নিয়ে রয়েছে প্রেম, প্রতারণা ও মালিকানার লড়াইয়ের এক অসাধারণ গল্প।
ঘটনার শুরু হয়েছিলো ১৯৬০ এর দশকে। দুজন ভিন দেশির প্রেম ও বিয়ের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে বাড়িটিতে। তাঁরা হলেন অস্ট্রীয় নাগরিক ইনগে ফ্লাৎজ এবং পাকিস্তানি ব্যবসায়ী মুহাম্মদ এহসান। ফ্লাৎজেরও ব্যবসা-সম্পত্তি ছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। আর বিয়ের পরও তিনি তাঁর পারিবারিক নাম ও জাতীয়তা ধরে রেখেছিলেন।
বাড়ি সংক্রান্ত মামলায় সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৬৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সে সময়ের ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, এখনকার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফ্লাৎজের নামে ১ বিঘা ১৩ কাঠা জমি বরাদ্দ দেয়। ট্রাস্টের পূর্বানুমতি নিয়ে তিনি সেখানে বাড়িটি তৈরি করেন।
যাহোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই সেই দম্পতির দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় ১৯৭২ সালে বাড়িটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং তাঁদের সম্পত্তি সরকারের মালিকানায় চলে যায়।
কিন্তু ফ্লাৎজ তাঁর মালিকানার দাবিতে আইনি লড়াই শুরু করেন এবং অস্ট্রীয় সরকারের সহযোগিতা চান।
১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে ঢাকার তিনজন অস্ট্রীয় রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন ফ্লাৎজের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া জন্যে।
অবশেষে, ১৯৮০ সালের জুন মাসে সরকার বাড়িটি তাঁকে ফিরিয়ে দেয়। এ বিষয়ে সে সময়ের বিএনপির মন্ত্রী মওদুদ আহমেদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বাড়িটি নিয়ে নতুন গল্প শুরু হয় ১৯৮১ সালের ২৩ মে যখন ফ্লাৎজ মওদুদকে বাড়িটি ভাড়া দেন একটি ইজারা চুক্তির মাধ্যমে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সময় থেকে মওদুদ গুলশানের বাড়িটিতে থাকতে শুরু করেন। গত জুন পর্যন্ত মওদুদ তাঁর পরিবার নিয়ে সেই বাড়িতে বসবাস করছিলেন।
এর মধ্যে ঘটে এক মজার ঘটনা। মহসিন দরবার নামে একজনকে ফ্লাৎজ মোক্তারনামা বা পাওয়ার অব অ্যার্টনি দেন বাড়ি সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ব্যাপারে। এমনকি, বাড়ি বিক্রির বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয় তাঁকে।
মামলা চলাকালে বাদি পক্ষের উকিল দাবি করেন, ১৯৮৫ সালের ১০ অক্টোবর মহসিন বাড়িটি মওদুদের ভাই মঞ্জুর আহমদের কাছে বিক্রি করে দেন।
মঞ্জুরও আদালতকে জানান যে বাড়ির বিক্রয় মূল্য ধার্য করা হয়েছিলো ৬০,০০০ স্টারলিং পাউন্ড। এর মধ্যে ২০,০০০ স্টারলিং পাউন্ড ফ্লাৎজকে অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হয়েছিলো এবং বাকিটা জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু, বাড়িটি রেজিস্ট্রেশনের জন্যে প্রয়োজনীয় আয়করের কাগজ এবং সম্পত্তি বিক্রির অনুমতিপত্র মহসিন দেখাতে ব্যর্থ হোন।
১৯৯৩ সালে বাড়িটি তাঁর নামে মিউটেশন করার অনুমতি চেয়ে ঢাকার একটি আদালতে আবেদন করেন মঞ্জুর। কিন্তু, ২০০১ সালে তাঁর সেই আবেদন খারিজ করে দিয়ে বলা হয় যে মহসিন দরবার একটি কাল্পনিক চরিত্র যা পাওয়ার অব অ্যার্টনি দেওয়ার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছিলো।
সেই মামলাটি শেষে হাই কোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।
সুপ্রিম কোর্টও জানান, মহসিন দরবার “একটি কাল্পনিক চরিত্র যা বাদি (মঞ্জুর আহমদ) সৃষ্টি করেছেন অসদুপায়ে সম্পত্তিটি দখল করা জন্যে।”
কোর্ট আরও জানান, ফ্লাৎজকে অগ্রিম টাকা দেওয়ার যে দাবি মঞ্জুর করেছেন এর পক্ষেও কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি।
সরকার যে তথ্য আদালতে দাখিল করেছে তাতে সন্দেহাতীতভাবে দেখা যায় যে এই ৩০০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি বিক্রির চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ফ্লাৎজ মারা যান।
এরপর, মঞ্জুর সুপ্রিম কোর্টে গেলে যেখানে তিনি তাঁর বাড়ির নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আইনি লড়াইয়ে হেরে যান। এই বাড়িতে মওদুদ গত ৭ জুন অর্থাৎ উচ্ছেদ হওয়া আগ পর্যন্ত বসবাস করছিলেন।
উচ্ছেদের সময় মওদুদ বলেছিলেন, বাড়িটির সঙ্গে তাঁর “আবেগ” জড়িত। কেননা, এ বাড়িটিতে তাঁর সন্তানেরা বড় হয়েছেন। তিনি বলেন, “বাড়িটি আমার কাছে শুধু একটি বাড়ি নয়, এরও বেশি কিছু।”
‘আসল’ মালিক হাজির
গল্পের শেষ এখানেই হয়নি। মনে হচ্ছে এটি আরও বহু দূর নিয়ে যাবে।
গত ২১ জুন অস্ট্রীয় নাগরিক করিম ফ্রানজ সোলাইমান নিজেকে ফ্লাৎজ-এহসান দম্পতির ছেলে হিসেবে পরিচয় দিয়ে বাড়িটির মালিকানা দাবি করেছেন।
৫৪ বছর বয়সী করিম ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে নিজেকে বাড়িটির উত্তরাধিকার হিসেবে দাবি করেন। তিনি আরও জানান যে বাড়িটি তাঁর নামে মিউটেশন করে দেওয়ার জন্যে তিনি ইতোমধ্যে সরকার এবং রাজউকের কাছে আবেদন করেছেন।
তাঁর মতে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে বাড়িটি এখনো তাঁদের পারিবারিক সম্পত্তি। মওদুদের বাড়ি ভাড়া দেওয়া বিষয়ে তিনি জানান, “একটি পয়সাও দেওয়া হয়নি।”
করিমের দাবি সম্পর্কে মওদুদ বলেন, “আমি আজ (বৃহস্পতিবার) সংবাদপত্রের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি না।”
২২ জুন করিমকে গুলশানের একটি হোটেল থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, “আমরা করিমকে আটক বা গ্রেফতার করিনি। তিনি পুলিশের কাছে এসেছিলেন বাড়ির মালিকানা ফিরিয়ে পাওয়ার বিষয়ে সহযোগিতা চাইতে।”
যাহোক, গুলশান এলাকার গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, “আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে এনেছিলাম।”
করিমের আইনজীবী জেনিফার আশরাফ জানান, তাঁর মক্কেল গত ১৭ জুন ঢাকায় এসেছেন বাড়িটিতে তাঁর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে এবং অন্য কারো হাতে পাওয়ার অব অ্যার্টনি দেওয়ার জন্যে। তিনি আরও জানান যে তাঁর হাতে পাওয়ার অব অ্যার্টনি দেওয়া হয়েছে।
করিম এখন কেনো ঢাকায় এলেন এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জেনিফার বলেন, “করিম তাঁর নিরাপত্তার বিষয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। এছাড়াও, যেহেতু বাড়িটি নিয়ে আইনি লড়াই চলছিলো তিনি এর রায়ের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।”
করিম একজন মেরিন বায়োলজিস্ট এবং অস্ট্রিয়াতে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করেন। ২০১৪ সালে জেনিফারের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেন এবং এরপর থেকে তিনি বিষয়টির ওপর নজর রাখছেন। করিমের কয়েকজন বাংলাদেশি বন্ধু রয়েছেন যাঁরা তাঁকে বিষয়টির চলমান অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন সময় অবহিত করতেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে করিম জানান, তাঁর মা ৪৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেই বাড়িটির মালিকানা ফিরে পেতে চেয়েছিলেন। কেননা, বাড়িটির সঙ্গে তাঁর অনেক স্মৃতি জড়িত। তিনি যখন বাড়িটি তৈরি করেন তখন তাঁর বয়স ছিলো ২২ বছরের মতো।
“আমি এখানে এসেছি বাড়িটির মালিকানা দাবি করতে। কেননা, এর সঙ্গে আমার মায়ের স্মৃতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত,” করিম যোগ করেন।
গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ করিমকে ছেড়ে দিলে সে রাতেই তিনি ঢাকা ছেড়ে অস্ট্রিয়ায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। রাত ১টার সময় তিনি ঢাকার বিমানবন্দরে ছিলেন।
Comments