রাম রহিমের যত কীর্তি!

সিনেমায় এভাবেই অভিনয় করতেন ভারতের বিতর্কিত ধর্মগুরু রাম রহিম সিং ইনসান। ছবিটি ভিটিও থেকে সংগ্রহ করা।

ভারতের ধর্মগুরুদের নিয়ে আগেও বহু বিতর্ক উঠেছে, এখনও আছে। কিন্তু বিতর্কের সঙ্গে বিতর্ক নিয়ে এমন সহিংসতা ভারতের ইতিহাসে প্রথম ঘটল শুক্রবার হরিয়ানায়। যদিও ধর্মীয় কারণে বহু সহিংসতার ঘটনা রয়েছে দেশটির ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তবে একজন ধর্মগুরুর ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায়; এমন নজিরবিহীন তাণ্ডবের দৃশ্য দেখল গোটা ভারতের মানুষ, বলা চলে বিশ্ববাসীও।

তাই এখনও ভারতীয় গণমাধ্যমেই শুধু নন বরং বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম উত্তরভারতের পিছিয়ে পড়া দলিত সম্প্রদায়ের কথিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং ইনসান। ৫০ বছর বয়সেই কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিকও তিনি। রয়েছে তার দীক্ষিত পাঁচ কোটি ভক্ত।

তারই দুই অনুগামী শিষ্যাকে ধর্ষণ করার অভিযোগ যেমন রয়েছে রাম রহিমের বিরুদ্ধে, তেমনই ধর্ষণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ‘অপরাধে’ একজন সাংবাদিক এমনকি ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধান ম্যানেজারকে খুনেরও অভিযোগ রয়েছে স্বঘোষিত এই ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে।

ভক্তের ভগবান এবং তান্ডব!

কিন্তু তাতে কি, তিনি যে পাঁচ কোটি ভক্তের কাছে ‘ভগবান’। ভগবানের সব অপরাধই লীলামাত্র।

আর তাই আইনের চোখে যাই হোক, এই এসব অপরাধের বিচার হওয়া যাবে না। ছেড়ে দিতে হবে তাদের ধর্মগুরুকে। বিচার করা যাবে না। এরকমই দাবিতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তাল ছিল উত্তর ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ রাজস্থানের কিছু অঞ্চল।

কিন্তু শুক্রবার যখন ওই পাঁচ কোটি ভক্তের ভগবানকে ধর্ষক হিসেবে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত দোষী সাব্যস্ত করল, তখনই ভক্তরা রাস্তায় নেমে পড়লেন।

গুরমিতের মোট অনুগামীর  মাত্র দশ শতাংশের তাণ্ডবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি রুপির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে শুক্রবার। পুড়েছে গাড়ি, রেল, বাস, দোকান, বাজার, বাড়ি। গুলি চলেছে অশান্ত ভক্তদের তাণ্ডব রুখতে। গুলিতে এখনও পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত ছুঁয়েছে। শুক্রবার থেকে ভারতীয় রেলের প্রায় ৪০০ নির্ধারিত সূচি বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে গুরুকে কারাবন্দি দেখে জ্বলছে ভক্তদের হৃদয়। সোমবার (২৮ আগস্ট) অপরাধের সাজা ঘোষণার পর কি তবে ওই ভক্তকূলের জ্বলন্ত হৃদয় থেকে লাভ বের হবে, জ্বলবে উত্তর ভারতের হরিয়ানা, পাঞ্জাব বা রাজস্থান রাজ্য?

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যদিও পরিস্থিতি সামাল দিতে কঠিন পদক্ষেপ নিতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কংগ্রেস শাসিত পাঞ্জাব রাজ্য কিছুটা হলেও শুক্রবার পরিস্থিতি সামলে নিতে পেরেছিল কিন্তু বিজেপির হরিয়ানা রাজ্য পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ও রাজ্যের হাইকোর্ট প্রশাসনের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ।

গণমাধ্যম বলছে, শুক্রবার ঘটনার দিকে নরেন্দ্র মোদি সার্বক্ষণিক নজর রাখছিলেন। রাতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব এবং নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে জরুরী বৈঠক করেছেন মোদি।

ধর্ষণ মামলায় আদালতে অভিযুক্ত হওয়ার পর অস্ত্র হাতে রাম রহিম সিং-এর সমর্থকদের মহড়া। ছবি: এএফপি

শনিবার (২৬ আগস্ট) রাজধানী নয়া দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বাড়িতে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্র সচিব, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান ছাড়াও সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা। সেখানে খতিয়ে দেখা হয় হরিয়ানা সরকারের ভূমিকা, নিরাপত্তা গাফিলতির পিন পয়েন্ট কিংবা আগামী সোমবার (২৮ আগস্ট)। সাজা ঘোষণার পর কী করণীয় এসব নানা দিক নিয়ে ওই বৈঠকে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় বলেই দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।

রাজনৈতিক দৃষ্টি

হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টরের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। রাজনৈতিক সূত্রের খবর দিল্লিতে এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বিজেপির কোর কমিটি। ইতিমধ্যেই বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও কথা বলেছেন। হরিয়ানা রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতাদের ডেকে পাঠানো হয়েছে দিল্লিতে। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, হরিয়ানা রাজ্য বিজেপির অভ্যন্তরে খট্টরের বিরুদ্ধে জরালো প্রতিবাদ উঠছে। পাঞ্জাব বিজেপি নেতৃত্বকেও জরুরি তলব করা হয়েছে অমিত শাহর দফতরে।

রাজনৈতিক সূত্র বলছে হরিয়ানার বিজেপি ক্ষমতায় আসার পেছনে স্বঘোষিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং ইনসান বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। বিজেপির শীর্ষ নেতারা হরিয়ানায় ভোটের আগে রাম রহিমের ডেরার গিয়ে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। অনেকে নেতার সেলফিও রয়েছে তাদের ফেসবুকে প্রোফাইলে। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও টুইট করে রাম রহিম সিং ইনসানের প্রশংসা করেছিলেন।

বিজেপির শীর্ষ নেতাদের ‘প্রিয়ভাজন’ মনে করেই ডেরা সাচ্চা সৌদার রাম রহিম সিং ইনসানের ভক্তদের রাগাতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর। সে কারণেই ১৪৪ ধারা জারি থাকলেও পুলিশ শুক্রবার পাঁচকুলায় সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতের বাইরে ভক্তদের জড়ো হতে বাধা দিতে পারেনি, যার খেসারত দিতে হলো এতো গুলো প্রাণ ও হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি।

কেন ভক্তরা এতো উত্তেজিত হলেন, কি আছে আছে রাম রহিম সিং ইনসানের মধ্যে?

বিজেপির শীর্ষ নেতা কৈলাশ বর্গ টুইটে লিখেছিলেন, ‘রাম রহিম সিংয়ের কাছে যাদু আছে যা তার কাছে না এলে বোঝা যাবে না।’

কী এমন যাদু সেটা অবশ্যই ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের ভক্তরা বলতে পারবেন কিন্তু তার জীবন বৃত্তান্ত দেখে সত্যিই চোখ কপালে উঠতেই পারে।

ডেরা সমর্থকদের বিরুদ্ধে চলছে পুলিশি একশন। ছবি: এএফপি

নজর কাড়া তথ্য

১৯৬৭ সালে ১৫ আগস্ট রাজস্থানের গঙ্গানগরে শ্রীগুরুসর মৌদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গুরমিত রাম রহিম। মাত্র সাত বছর বয়স থেকেই বাড়ি ছেড়ে শিখ ধর্মের এক গুরুর কাছে প্রতিপালিত এবং শিখ ধর্মের দীক্ষিত হতে থাকেন। সেখানে থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে ১৯৯০ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর ডেরা সৌদার প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হন এবং সর্বধর্ম সমন্বয়ক হিসেবে নিজের প্রচার শুরু করেন। মূলত দলিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষই তাকে নিজেদের গুরু হিসাবে মনে করতে শুরু করেন। প্রথম দিকে তেমন জনপ্রিয় না পেলেও পরবর্তীতে আস্তে আস্তে নিজের অবস্থান পাকা করতে শুরু করেন। এর কারণ হচ্ছে, তিনি বিভিন্ন রক্তদান শিবির করতেন, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন করতেন, অর্থাভাবে পড়াশোনা করতে না পাড়া মেয়ে ও ছেলেদের পড়ানোর খরচ বহন করতেন। হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে যেখানে সরকারি পরিসেবা নেই সেখানে তার অর্থ সাহায্যে হাসপাতাল, বাজার ও পরিবহনও চলতো প্রায় বিনামূল্যে। বৃক্ষরোপণ নিয়েও রাম রহিমের সারা বছরই কর্মসূচি চলে। রক্তদান শিবির ছিল তার ডেরার প্রধান কাজ। ২০০৩ সালে পৃথিবীর বৃহত্তম রক্তদান শিবির করে গিনেজবুক অব রেকর্ড-এ নাম লিখিয়েছেন রাম রহিম সিং ইনসান। হরিয়ানার সারদায় ৮০০ একর জমির ওপর তৈরি হওয়া কর্মসংস্থান প্রকল্পে প্রায় ২০ হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান করেছেন। সেখানে সেখানে অর্গ্যানিক মধু ও নুডলস তৈরি হয়। হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে তার ডেরা সৌদার প্রায় পাঁচ হাজার ক্যাম্প অফিস আছে। আর সেই ক্যাম্প অফিসের নথিভুক্ত ভক্তের সংখ্যা পাঁচ কোটি। এতো বড় ভক্ত-অনুগামী থাকায় স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের চোখে ভোটের মধু খেতে ‘প্রিয়পাত্র’ হয়ে উঠেছিলেন গুরুমিত। যদিও নিজে কংগ্রেস আদর্শে বিশ্বাস বলে দাবি করতেন। কিন্তু ২০১৪ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে সমর্থন করায় হরিয়ানায় বিজেপি জয় পেয়েছিল। একইভাবে ২০১৫ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনেও প্রকাশ্যে রাম রহিম সিং ইনসান সমর্থন জানিয়েছিল বিজেপিকে। সেখানে জয় হয়েছিল বিজেপিরই। এমন কি বিহার বিধানসভা নির্বাচনেও প্রকাশ্যেই বিজেপির হয়ে ভোট ভিক্ষা করেছিলেন গুরমিত রাম রহিম সিং।

রাম রহিমের বিরুদ্ধে তিনটি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। ২০০২-এ সিরসার এক সাংবাদিক রাম চন্দ্র ছত্রপতিকে খুনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওই একই বছরে ডেরার ম্যানেজার রঞ্জিত সিংহকে খুনের অভিযোগ ওঠে।  

রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে চিঠি লেখেন তারই ডেরার অজ্ঞাত দুই শিষ্যা। শিষ্যারা অভিযোগ করেন, অন্য শিষ্যাদেরও হরিয়ানার সিরসায় ডেরা চত্বরে একাধিক বার ধর্ষণ করেছেন রাম রহিম। এরপরই বিষয়টি নজরে আসে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট সিবিআইকে রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা রুজু করার নির্দেশ দেয়।

২০০২ সালে সিবিআইকে গোপন জবানবন্দিতে একজন শিষ্যা জানান যে, তিনি ডেরা প্রধানের চেম্বারে ঢোকার পরই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এবং রাম রহিম বড় স্ক্রিনে পর্নোগ্রাফি ছবি দেখছেন তখন। এরপরই তাকে হাতে পিস্তলও দেখিয়েছিলেন। এরপরই তাকে ধর্ষণ করা হয়। প্রায় তিন বছরে ধরে নিয়মিত ধর্ষণ করা হতো তাকে।

রাম রহিমের বিরুদ্ধে শিখ ধর্মের ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগ উঠে ২০০৭ সালে। তার বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়। যদিও ২০০৯ সালে হরিয়ানার সিরসা আদালত এবং ২০১৪ সালে ভাতিন্ডা আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন।

ধর্মীয় গুরু ছাড়াও রাম রহিম সিং নিজে একজন গায়ক, অভিনেতাও। এমএসজি: দ্য মেসেঞ্জার, এমএসজি২ দ্য মেসেঞ্জার, এমএসজি: দ্য ওয়ারিয়র লায়ন হার্ট নামে তিনটি ছবিও করেছেন গুরমিত। ভারতে জেড ক্যাটাগরির সুরক্ষা পান রাম রহিম। গোটা ভারতের এই রকম নিরাপত্তা পান মাত্র ৩৬ জন মানুষ।

Comments

The Daily Star  | English

JCD blocks Shahbagh again demanding justice for Shammo murder

The protesters also demanded the resignation of the vice-chancellor and proctor of Dhaka University

19m ago