রোহিঙ্গা: রাজা থেকে শরণার্থী

একজন রোহিঙ্গা মা কীভাবে প্রমাণ করবেন যে নিজের বলে দাবী করা সন্তানের তিনি আসল মা?
Rohingya repatriation
বাংলাদেশের সীমান্ত অভিমুখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল। স্টার ফাইল ছবি

একজন রোহিঙ্গা মা কীভাবে প্রমাণ করবেন যে নিজের বলে দাবী করা সন্তানের তিনি আসল মা?

মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গা মায়েদের জন্য এক অভিনব উপায় বাতলে দিয়েছে। সরকারের হুকুম হল কোনো রোহিঙ্গা দুইটির বেশি সন্তান নিতে পারবে না। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে ১০ বছর পর্যন্ত জেল ও আর্থিক জরিমানা হতে পারে। বাড়ি বাড়ি তল্লাশির সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের যদি সন্দেহ হয় তাদের ফাঁকি দেয়ার জন্য কোনো রোহিঙ্গা মহিলা অন্য জনের শিশুকে নিজের কাছে রেখেছে, ওই শিশুর আসল মাকে রক্ষা করতে, তাহলে বাহিনীর সদস্যরা ওই মহিলাকে তাদের সামনেই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে বাধ্য করতে পারবে। এর মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে ওই সন্তান তারই। আর সন্তানটি যদি দুগ্ধ পোষ্য  না হয় তাহলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে পৃথক ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তার আসল পরিচয় জানতে।

২০০৫ সালে এক ফরমান জারি করে জান্তা সরকার দুই সন্তান সংক্রান্ত বিধি নিষেধ বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে এমন কুৎসিত এবং নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা দেয়। ব্যাংকক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন, ফরটিফাই রাইটস, ২০১৪ সালে এক প্রতিবেদনে জান্তা সরকারের এ সংক্রান্ত আদেশর দলিল প্রকাশ করে।

যতই উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং মানবাধিকার পরিপন্থি প্রতীয়মান হোক না কেন এটাই রোহিঙ্গাদের জন্য বাস্তবতা। এমন বৈষম্যমূলক ফরমানের পক্ষে সাফাই গেয়ে জান্তাদের কর্মকর্তারা বলেন যে, রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে, এতে করে স্থানীয় বৌদ্ধরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ করছে। বৌদ্ধদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে চাইলে কোনো রোহিঙ্গা দম্পতি দুইটির বেশি সন্তান নিতে পারবে না।

তবে জন সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মানবাধিকার পরিপন্থি নীতিও রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা থামাতে পারেনি। বরং ২০১২ সাল থেকে তাদের উপর সহিংসতা বেড়ে গেছে অনেক গুণ। গত অগাস্ট মাস থেকে তাদের উপর বর্বরতা চলছে। তার আগে তাদের ২০১২ এবং ২০১৬ সালেও রোহিঙ্গারা সহিংস আক্রমণের শিকার হয়েছে।

আর আশ্চর্যের বিষয় হল, ২০১২ সালের ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা তদন্তের জন্য জান্তা সরকার যে কমিশন গঠন করে, সেই কমিশনও রোহিঙ্গা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে ২০১২ সালে এক দল বৌদ্ধ দুষ্কৃতিকারী রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ চালায়। রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘর বাড়িতে আগুন দেয়। ১৯৯০ সালের পর ওটাই ছিল বড় সহিংসতা। ওই সহিংসতায় ২০০ জন নিহত হয় এবং এক লাখ ২৫ হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়, যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। তবে ২০১৩ সালে জমা দেওয়া জান্তা কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে ওই সহিংসতার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়নি।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দুই সন্তান সংক্রান্ত ফরমানের তীব্র সমালোচনা করে। তারা একে বৈষম্যমূলক এবং মানবাধিকার পরিপন্থি হিসেবে অভিহিত করে। এমনকি অং সান সু চি ও সে সময় এই ফরমানের নিন্দা জানান এবং একে মানবাধিকার পরিপন্থি আখ্যায়িত করেন।

তবে জান্তা সরকার ওসব সমালোচনায় কর্ণপাত করেনি। কারণ পরিষ্কার। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক এবং মানবাধিকার বিরোধী ব্যবস্থা নতুন কিছু নয়। ১৯৯৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সরকারের জারি করা এক ডজন আদেশ পর্যালোচনা করে ফরটিফাই রাইটস, ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে জানায় যে, রাখাইনে জান্তা সরকারের নীতিই বৈষম্যমূলক। চলাচল, সন্তান জন্মদান, মৌলিক চাহিদায় পূরণসহ নানা বিষয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

২০১৬ সালে সু চির নেতৃত্বে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের যাত্রা শুরু হলেও রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। কারণ, সু চির সরকারও যেন জান্তা সরকারেরই বর্ধিত রূপ। তার সরকারও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জান্তা সরকারের নীতি অনুসরণ করে নতুন আদেশ জারি করে। যেমন, ২০১৬ সালের জুনে তথ্য মন্ত্রণালয় সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমের কাছে আদেশ পাঠায় যে, এখন থেকে রোহিঙ্গাদেরকে আর রোহিঙ্গা লিখা যাবে না। তাদেরকে রাখাইনের মুসলিম কমিউনিটি হিসেবে অভিহিত করতে হবে। সু চি নিজেও জাতিসংঘের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করতে বারণ করেন। এর মাধ্যমে সু চি সরকার রোহিঙ্গাদের পরিচয় মুছে ফেলার আয়োজন সম্পন্ন করে। এটা জান্তা সরকারের নীতিরই অনুসরণ। জান্তা সরকার ১৯৮২ সালে আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করে। ১৯৮৩ সালের পর বার্মায় আগত রোহিঙ্গাদের ভাসমান নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে বার্মায় রোহিঙ্গাদের সম্পত্তি অর্জন, রাজনৈতিক অধিকার ও অবাধ বিচরণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের উপর নতুন করে নির্যাতন শুরু হয়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়নে দীর্ঘ দিনের নীল নকশার অংশ হিসেবেই নাগরিকত্ব হরণ করে তাদেরকে রাষ্ট্রহীন করা হয়।

২০১৪ সালে আদমশুমারি সময় রোহিঙ্গাদের আরেক দফা ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। শুরুতে তাদেরকে রোহিঙ্গা হিসেবেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু তাতে বাধ সাধে বৌদ্ধ চরমপন্থিরা। তারা এর প্রতিবাদ জানায় এবং শুমারি বর্জনের হুমকি দেয়। হুমকির মুখে জান্তা সরকার সিদ্ধান্ত বদলায়। নতুন আদেশ জারি করে বলে যে, রোহিঙ্গারা বাঙালি হিসেবে শুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।

বৌদ্ধ চরমপন্থিদের দাবির মুখে পরের বছর ২০১৫ সালে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। যদিও জান্তা সরকার আগে ঘোষণা করেছিল যে, যাদের অস্থায়ী পরিচয়পত্র আছে তারা সংবিধান সংক্রান্ত গণভোটে অংশ নিতে পারবে। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে সরকার অস্থায়ী পরিচয়পত্র বাতিল করে দেয়।

অস্থায়ী পরিচয়পত্রধারী রোহিঙ্গারা ২০০৮ সালে সংবিধান সংক্রান্ত গণভোটে এবং ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল। তবে ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাদেরকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

রাজা থেকে শরণার্থী

মধ্যযুগে আরাকান রাজ্যটি ব্যবসা, বাণিজ্য, জ্ঞান এবং সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অগ্রসরমান ছিল। সতের শতকে আরাকানের রাজধানী শহরকে দ্বিতীয় ভেনিস হিসেবে কেউ কেউ অভিহিত করতেন। আমস্টারডাম এবং লন্ডনের সাথেও তার তুলনা করা হত। বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, ১৭৩১ থেকে ১৭৮৪ সালের মধ্যে আরাকান রাজ্যে ১৩ জন রাজা শাসন করেন।

১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা আরাকান দখল করে নেয়ার পর থেকে সে স্বর্ণ যুগের অবসান ঘটতে শুরু হয়। তখন থেকেই আরকানবাসীর দুর্ভোগ শুরু। পরবর্তীতে বার্মা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে পরিবর্তন আসেনি। স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৪৮ সালে বার্মায় আরাকানি বৌদ্ধ এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। স্বাধীন বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের উপর দমন পীড়ন শুরু করেন। বিদ্রোহ দমনের নামে ১৯৫০ সালে তাদের বিরুদ্ধে প্রথম সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হয়। দুই বছর পর ১৯৫২ সালে অপারেশন মায়ু নামে পুনরায় সামরিক অভিযান চালানো হয়। অন্যদিকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের মধ্যেও প্রতিবাদ দানা বাধতে থাকে। অনেকে বিদ্রোহীর খাতায় নাম লেখায়। ১৯৫৪ সালে অপারেশন মনসুন নামে সামরিক বাহিনী আরো জোরালো অভিযান শুরু করে। ১৯৬১ সালে বিদ্রোহীরা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

পরের বছর ১৯৬২ সালে বার্মার সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়। ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী নিপীড়ন আরও বাড়িয়ে দেয়। হাতে নেয় রোহিঙ্গা নিধন পরিকল্পনা। ১৯৭৪ সালে আরকান রাজ্যর নাম পরিবর্তন করে রাখাইন রাখা হয়। বহিরাগত তাড়ানোর নামে ১৯৭৮ সালে সেনাবাহিনী অপারেশন কিং ড্রাগন শুরু করে। ধর্ষণ, নির্বিচারে গ্রেফতার, গ্রাম ধ্বংস এবং জমির মালিকানা কেড়ে নেয়া চলতে থাকে। এতে করে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা প্রাণের ভয়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

একই উদ্দেশ্য নিয়ে সামরিক বাহিনী আবার রোহিঙ্গা খেদাও অভিযান শুরু করে ১৯৯১ সালে। অপারেশন ক্লিন এন্ড বিউটিফুল নামে চালানো দমন নিপীড়নে কারণে তখন প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

তবে ২০১২ সাল থেকে চলমান নিপীড়ন এবং সহিংসতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়ায়। এর রেশ কাটার আগেই ২০১৬ সালে আবার শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধন অভিযান। আর গত আগস্ট থেকে শুরু করা ক্লিয়ারেন্স অপারেশন নির্মমতা গোটা বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সরকারের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৪০০ জন মারা গেছে, যদিও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বলছে নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার হতে পারে। রোহিঙ্গাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।

চলমান বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রতিবাদের ঝড় বইছে বিশ্বজুড়ে। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে মিয়ানমার সরকারকে, কিন্তু এতেও তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রোহিঙ্গা নিধন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কী তাদের এ অভিযান কেউ থামাতে পারবে না?

Comments

The Daily Star  | English

Old, unfit vehicles taking lives

The bus involved in yesterday’s crash that left 14 dead in Faridpur would not have been on the road had the government not given into transport associations’ demand for keeping buses over 20 years old on the road.

18m ago