পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রাহক দীপ মুখোপাধ্যায়

​‘মানুষের জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে পেঁচা’

তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেছেন সাংবাদিকতা দিয়ে। এরপর, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা হয়েও স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিজেকে পরিচিত করতে শুরু করেন একজন লেখক হিসাবে। আশির দশক থেকে তাঁর খ্যাত ছড়িয়ে পড়ে একজন ছড়াকার হিসাবে।
Dip
পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রাহক দীপ মুখোপাধ্যায়। ছবি: স্টার

তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেছেন সাংবাদিকতা দিয়ে। এরপর, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা হয়েও স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিজেকে পরিচিত করতে শুরু করেন একজন লেখক হিসাবে। আশির দশক থেকে তাঁর খ্যাত ছড়িয়ে পড়ে একজন ছড়াকার হিসাবে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে জীবিত লেখকদের মধ্যে এই মুহূর্তে প্রথম সারির লেখক তিনি। তাঁর নাম দীপ মুখোপাধ্যায়।

কলকাতার আনন্দ বাজার, বর্তমান, সংবাদ প্রতিদিন, এইসময়, দেশ, কিশোর ভারতী থেকে আনন্দমেলার মতো সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় দীপ মুখোপাধ্যায়ের লেখা পড়ার অভ্যাস অনেকেরই গড়ে উঠেছে গত তিন দশকে।

পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা নয়, ঢাকার র্শীষ দৈনিক পত্রিকাগুলোর ঈদ সংখ্যায় দীপ মুখোপাধ্যায়ের ছড়া কিংবা লেখা পড়েন বাংলাদেশের পাঠকদের অনেকেই।

কিন্তু সাংবাদিক, ছড়াকার দীপ মুখোপাধ্যায় যে একজন সংগ্রাহক; সেটা হয়তো অনেকের কাছে অজানা। সংখ্যার বিচারে পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তিগত পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রাহক তিনি।

দীপ মুখোপাধ্যায় রেপ্লিকা সংগ্রহের কাজটি করে চলেছেন অনেকটা নীরবে। পেঁচা নিয়ে তাঁর পড়াশোনাও বিস্তর। পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রহ করতে তাঁর ঘুরে বেড়ানোর ইতিহাস নিয়েও লেখা যাবে বই। এই পর্যন্ত ১২ হাজার পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রহ করেছেন এই ছড়াকার। তাঁর দাবি, পৃথিবীতে এই ধরণের সংগ্রহ আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রথমদিকে তাঁর শখ ছিল এই সংগ্রহ। তবে এখন পুরোপুরি বাধ্যবাধকতা ও দায়বদ্ধতাও। এটি বিলুপ্তপ্রায় পেঁচাকে রক্ষা করার দায়। বিষয়টিকে এভাবেই প্রচার করতে চান দীপ।

দক্ষিণ কলকাতার ১৩১/১ রাসবিহারী রোডের ৪-ডি আবাসনের বাসিন্দা দীপ মুখোপাধ্যায়। গত ২৭ মে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। তিনি বলেন পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রহ নিয়ে তাঁর জীবনের নানা অজানা কথা।

দ্য ডেইলি স্টার: আরও তো অনেক প্রাণী রয়েছে পৃথিবীর কোলে, কিন্তু পেঁচার প্রতি কেন আকর্ষণ তৈরি হলো?

দীপ মুখোপাধ্যায়: পেঁচা তার মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরাতে পারে। যে প্রাণী এভাবে মাথা ঘুরাতে পারে বা সামনে পেছনে দেখতে পারে – প্রাণি দর্শনে তার সব করায়ত্ত হবে। পেঁচার সঙ্গে আমারও মিল রয়েছে। দিনের বেলায় সে (পেঁচা) ভালো দেখতে পারে না, কিন্তু রাতে ভীষণ প্রখর এবং তুখড় দৃষ্টি এর।

আমিও সারাদিন ব্যস্ত থাকার পর রাতের বেলায় নিজেকে অনেক বেশি স্বাছন্দ বোধ করি। নিজেকে পেঁচার মতোই ভাবতে শুরু করি। এইসব মিলিয়ে যেন পেঁচার প্রতি আমার একটা তীব্র আকর্ষণ তৈরি হয়। আরও বলতে গেলে, যতটা না পেঁচার প্রতি, পেঁচাকে নিয়ে যতটা শিল্পকর্ম তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে, রেপ্লিকা – সেগুলো নিয়েই আমার বেশি আগ্রহ।

দ্য ডেইলি স্টার: সংগ্রহের কাজটা কবে থেকে শুরু হয়েছে মনে আছে আপনার?

দীপ মুখোপাধ্যায়: ১৯৭৮ সালে জয়দেব কেন্দু বলে এক বাউল মেলায় ঘুরতে গিয়ে সেখান থেকে একটা কাঠের পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রহ করেছিলাম। মাত্র পঁচিশ পয়সা দিয়ে কেনা সেটি। হয়তো আমার মতো অনেকেই অনেক কিছু বাড়তি নিয়ে যায়। কিন্তু, আমি ওই পেঁচাটা নিয়ে বাড়িতে আসার পর ভাবতে শুরু করলাম, পেঁচাটা খুবই নিঃসঙ্গ। তার একজন বন্ধু দরকার। সেই বন্ধুর খোঁজে আমি শুশুনিয়া পাহাড়ের পাথুরে পেঁচাকে নিয়ে এলাম। এরপর মনে হলো, তার আরও বন্ধু দরকার - এভাবে তার বন্ধু বাড়তে লাগলো। সারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের পেঁচারা আসতে শুরু করলো। শোলা, ডোকরা, ইট, গালা, বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটি, টেরাকোটা, এভাবেই পেঁচার সংসার বেড়েই চললো। কিন্তু তাতেও আমার মনের ইচ্ছেটা পূরণ হচ্ছে না। আমি দেখলাম, সারা পৃথিবীর শিল্পীরা বিভিন্নভাবে পেঁচা তৈরি করে যাচ্ছেন।

ডক্টর সালিম আলির পাখির বই দেখেছিলাম, তাতে পেঁচার যেসব আর্ট প্লেট ওনি এঁকেছিলেন, এই উপমহাদেশে সেই অনেক পেঁচাই এখন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, যা আছে তা শিল্পীর চোখে দেখা পেঁচাগুলোর সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। আমার পর্যবেক্ষণ হলো, কী গভীর মনোনিবেশ করে ওই শিল্পীরা পেঁচাগুলোকে মূর্ত করে তুলেছিলেন – সেটা কিন্তু সত্যিই ভাবনার বিষয় আমার কাছেও।

দ্য ডেইলি স্টার: আমরা জানি আপনি দেশ-বিদেশের পেঁচা সংগ্রহে গিয়েছেন, কোথায় কোথায় গিয়ে পেঁচা রেপ্লিকা এনেছেন আপনি?

দীপ মুখোপাধ্যায়: ভারতবর্ষের বাইরে বিভিন্ন দেশ থেকেই এই রেপ্লিকা সংগ্রহ করেছি। যেমন পেরু, থাইল্যান্ড, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, সিঙ্গাপুর এবং অবশ্যই বাংলাদেশও আছে। কিছু দেশে আমি যেতে পারেনি। আমার বন্ধুদের দিয়ে সংগ্রহ করেছি। আবার ইন্টারন্যাশনাল অকশনেও বিড করে পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রহ করেছি। তাছাড়াও, অনেকেই আমাকে উপহারও হিসেবে পেঁচার রেপ্লিকা দিয়েছেন।

দ্য ডেইলি স্টার: পেঁচা নিয়ে ধর্মীয় তত্ত্বে বিশ্বাসী আপনি?

দীপ মুখোপাধ্যায়: হিন্দুরা যেমন মা লক্ষ্মীর বাহন হিসাবে পেঁচাকে মনে করে আসছেন তেমনই গ্রিসে দেবী এ্যাথেনারও বাহন পেঁচা। সে কারণে গ্রিসে পেঁচার একটি বিশেষ জায়গা রয়েছে। গ্রিসের মানুষের কাছেও পেঁচা সৌভাগ্যের প্রতীক।

দ্য ডেইলি স্টার: মানুষের সঙ্গে পেঁচার মিল-অমিল নিয়ে কখনো কিছু কি ভেবেছেন?

দীপ মুখোপাধ্যায়: আমি এখনো এটাই খুঁজে বেড়াচ্ছি জানেন। মানুষ পেঁচাকে কি দৃষ্টিতে দেখছেন? আমার মনে হয়, মানুষ পেঁচাকে অনেকটাই মানুষের মতোই ভাবে বোধ হয়। যেমন, একটা মানুষের চেপটা মুখ, তার অভিব্যক্তিতে রাগ, কখনো সে ঘুমচ্ছে, কখনো বুড়ো দাদুর মতো; মানুষের কল্পনাও অনেকটা পেঁচার ওপর মেলে দেওয়া রয়েছে। আর সে কারণেই মনে হয় সারা পৃথিবীর বিভিন্ন শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্ম সমৃদ্ধ করেছেন পেঁচা দিয়ে। পেঁচা গ্রিসের কয়েনেও পাওয়া গিয়েছে। দ্বিতীয় শতাদ্বীর দ্রাখমা কয়েনেও মিলেছে পেঁচার ছবি। এটা অবশ্যই আমার নিজের কাছেই রয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনার কাছে থাকা পেঁচাগুলো কি সত্যিই দুষ্প্রাপ্য?

দীপ মুখোপাধ্যায়: অনেক সংগ্রাহক বলেন, আমার কাছে যে পেঁচা রয়েছে তা নাকি পৃথিবীর আর কারও কাছেই নেই। কিন্তু আমি বলি, আমি যে পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রহ করেছি সেগুলো ইচ্ছা করলেই যে কেউ সংগ্রহ করতে পারবেন। এগুলো সহজলভ্য। সহজলভ্য পেঁচার রেপ্লিকাই আমার এই সংগ্রহের কারণ।

১৯৭৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমার সংগ্রহ ১২ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমি এই রেপ্লিকাগুলো নিয়ে ক্যাটালগ তৈরি করার কাজ শুরু করেছি।

দ্য ডেইলি স্টার: পেঁচার রেপ্লিকা সংগ্রহে জীবনে মজার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই রয়েছে, যদি স্টারের পাঠকদের জন্য কিছু বলেন।

দীপ মুখোপাধ্যায়: জীবনে অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটেছে। এগুলো বললে অনেক সময় লাগবে। তাই একটি মাত্র ঘটনার কথা বলছি – অনেক দিন আগের কথা, আমি এবং আমার স্ত্রী শুভ্রা একজনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম একটি চেকোস্লোভাকিয়ার কাঠ-গ্লাসের এবং একটি ফ্রান্সের পেঁচার রেপ্লিকা। দুটো পেঁচা দেখে লোভ হলো ভীষণ। ভাবছিলাম, দুটিই চুরি করে নিয়ে আসবো। আবার এটাও ভাবলাম যে কাজটা অন্যায় হবে। কিন্তু, কী আশ্চর্য! যাঁর বাসায় ওটা দেখলাম, বাড়ির গৃহকর্তা আমার মনোভাব বুঝতে পেরে নিজেই বললেন, “তুমি ওই পেঁচা দুটি চুরি করার চিন্তা করছো তো - চুরি করতে হবে না। আমি ওটার মতো আরেকটা পেঁচা তোমাকে এনে দেবো।”

তবে চুরি আমাকে সত্যিই করতে হয়েছিলো, সেই সত্যটা প্রকাশ করতে চাই না। আমাকে চোরাই পেঁচাও সংগ্রহ করতে হয়েছে। ভয়ে ভয়ে থাকি সেই কারণে। কারণ, ওই পেঁচাগুলো অ্যান্টিক পেঁচা। অ্যান্টিক কিছু রাখতে হলে অনুমোদনের প্রয়োজন হয়, সে কারণে আমার ডিসপ্লে বোর্ডেও ওই পেঁচাগুলোর রেপ্লিকা দেইনি। তবে আমি সরকারের কাছে অনুমোদন চেয়ে আবেদনও করে রেখেছি।

দ্য ডেইলি স্টার: রেপ্লিকা সংগ্রহ এবং বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলবেন কি?

দীপ মুখোপাধ্যায়: সারা পৃথিবীর মধ্যে আর্টফর্মে বাংলাদেশ যথেষ্ট এগিয়ে আছে। পেপারম্যাট, টেরাকোটা, পাট – এই তিন মাধ্যমের পেঁচার রেপ্লিকা বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করেছি। প্রত্যেকটি পেঁচার শৈল্পিক গুণ অসাধারণ।

দ্য ডেইলি স্টার: কি করবেন বিশাল রেপ্লিকা ভাণ্ডার নিয়ে?

দীপ মুখোপাধ্যায়: থাইল্যান্ডে একটি জাদুঘর রয়েছে যেখানে পেঁচার মাত্র দু’হাজার রেপ্লিকা রয়েছে। তবে তত্ত্বে এবং সংখ্যায় আমার সংগ্রহের সমকক্ষ নয় সেটি। আমার ইচ্ছা ছিলো, এই রকম একটি জাদুঘরকেই দেওয়া। কিন্তু ওরা যে ধরণের ব্যবসা করে, সেই ব্যবসায়িক কোনও পরিকল্পনা আমার নেই। কোনও গবেষক যদি গবেষণার জন্য পেঁচার রেপ্লিকাগুলো নিতে চান সেরকম কোনও গবেষণাগারে আমি পেঁচাগুলো দিয়ে যেতে চাই।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনি প্রায় ৩৯ বছর ধরে পেঁচা সংগ্রহ করে চলেছেন। দীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছেন। অর্থ কিংবা শ্রম এগুলো নয় বাদই পড়লো। এখনো কি কোনও আক্ষেপ রয়েছে আপনার মধ্যে?

দীপ মুখোপাধ্যায়: দেখুন, শিল্পীরাও যেমন শেষ হয়ে যাচ্ছেন, তেমনই পেঁচাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। দুটো স্বত্বাকেই টিকিয়ে রাখতে হলে খুব শিগগির একটি জাদুঘর হওয়া দরকার। আর এর মধ্য দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি যেমন হবে, তেমনই সৃষ্টি হবে দায়বদ্ধতাও। আমি চাই আমার যে শখ সেটা যেন সবার মধ্যেই তৈরি হয়। পেঁচার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দায়বদ্ধতাও যেন আসে মানুষদের মধ্যে। আমাদের সঙ্গে পেঁচা যেন পেঁচিয়ে আছে বা জড়িয়ে রয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনাকে ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্যে।

দীপ মুখোপাধ্যায়: আপনাকেও ধন্যবাদ।

Comments

The Daily Star  | English
Dhaka Metro rail transported 3.35 lakh commuters since opening

Metro rail: Dhaka University and Bijoy Sarani stations to open Dec 13

The Dhaka University and Bijoy Sarani stations of the metro rail service will open for public on December 13

40m ago