উত্তর কোরিয়ার ‘হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র’ পরীক্ষার তাৎপর্য

ছবি: দ্য কোরিয়া হেরাল্ড থেকে নেওয়া

সম্পদ ও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়া উন্নত বিশ্বের পরাশক্তি, 'শত্রু রাষ্ট্র' ও যেকোনো সম্ভাব্য হামলাকারীর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার সঙ্গে টক্কর দিতে চাইছে।

উত্তর কোরিয়া গত বৃহস্পতিবার দাবি করেছে তারা সফলভাবে আরও এক ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। ক্ষমতা গ্রহণের ১০ বছর উপলক্ষে গত ১ জানুয়ারির বক্তৃতায় কিম জং উন পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়ে তার দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু, মাত্র ৪ দিন পর ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় কোরীয় উপদ্বীপের দেশটি।

এর ঠিক ১০০ দিন আগে তারা 'হোয়াসং-৮' নামের আরেকটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণা দিয়েছিল।

ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানায়, উত্তর কোরিয়ার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে ৫ গুণ বেশি দ্রুত (ঘণ্টায় ৬ হাজার ২০০ কিলোমিটার) বেগে ও অনেক নিচ দিয়ে উড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। এটি আগের অনেক মডেলের চেয়ে শত্রুপক্ষের রাডার এড়াতে বেশি সক্ষম।

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা কেসিএনএ জানিয়েছে, এই পরীক্ষার মাধ্যমে কার্যকর ও ধাবমান অবস্থায় ক্ষেপণাস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা হাইপারসনিক গ্লাইডিং ওয়ারহেডের 'ল্যাটেরাল মুভমেন্ট টেকনিকের' কার্যকারিতা নিশ্চিত হয়েছে।

কেসিএনএ আরও জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্রটি ৭০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে অব্যর্থ আঘাত হানে। কিন্তু এর মধ্যে সেটি ১২০ কিলোমিটারের বাড়তি (ল্যাটেরাল) দূরত্বও পার হয়। একই সঙ্গে 'শীতকালীন আবহাওয়ায় ক্ষেপণাস্ত্রের ফুয়েল অ্যাম্পুল ব্যবস্থার নির্ভরযোগ্যতা' সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।

এই কারিগরি তথ্যগুলো নানা দিক থেকে অর্থবহ।

করোনা মহামারি নিয়ে বৈশ্বিক খাদ্য ও সরবরাহ সংকট ও বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে মন্দা থাকলেও দেখা যাচ্ছে প্রধান সামরিক শক্তিগুলো প্রায়ই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে অন্যদের থেকে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া। এই দেশগুলো গত ১ মাসের মধ্যে 'হাইপারসনিক' অর্থাৎ শব্দের চেয়ে কয়েকগুণ দ্রুতগতিসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার দাবি করেছে।

বিবিসির প্রতিবেদন মতে, বিশ্লেষকরা বলছেন, পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পর্ব চলছে।

এতদিন ধরে বিভিন্ন দেশের হাতে যেসব দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, সেগুলো কম-বেশি উপযোগিতা হারিয়েছে। সবাই এখন এই শূন্যস্থান পূরণে নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি খুঁজছে।

এর মূল কারণ, পরাশক্তিগুলোর হাতে থাকা সব প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা প্রতিহত করার বা সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার কৌশল ইতোমধ্যে প্রতিপক্ষ দেশগুলো বের করেছে এবং বাস্তবায়নও করে রেখেছে।

এই পরিস্থিতিতে শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে উড়তে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রই হয়তো পারবে অতি জরুরি সামরিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে। বিষয়টিকে মাথায় রেখেই বিভিন্ন দেশের অস্ত্র বিজ্ঞানীরা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের গবেষণায় সময় ও সম্পদ খরচ করছেন। ফলে, এমনসব ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হচ্ছে যেগুলো খুবই দ্রুতগতিতে আঘাত হানতে পারবে যা বর্তমান প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি দিয়ে মাঝপথে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব।

আগের দিনের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মূলত উড্ডয়নস্থল থেকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে উড়ে যেতে পারতো। একবার ছুঁড়ে দেওয়ার পর আর সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার তেমন কোনো উপায় ছিল না। শত্রুপক্ষের রাডারে ধরা পড়ার পর পথিমধ্যে অন্য কোনো প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র, যেমন উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত প্যাট্রিয়ট মিসাইল ব্যবহার করে খুব সহজেই তাদের ধ্বংস করে দেওয়া যেত।

কিন্তু, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র খুব দ্রুত গতিতে ছুটে। তাই তাদের রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতাও বেশি। এ ছাড়াও, 'ল্যাটেরাল মুভমেন্ট' বা গতিপথ পরিবর্তন করেও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যেতে পারে।

তবে দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাদের যৌথ বিশ্লেষণ ও উত্তর কোরিয়ার গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মধ্যে বেশকিছু বৈসাদৃশ্য দেখা গেছে।

জেমস মার্টিন সেন্টার ফর ননপ্রলিফারেশন স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট জশুয়া পলোক কোরিয়া হেরাল্ডকে বলেন, 'আমার ধারণা, একে (এই ক্ষেপণাস্ত্রকে) হাইপারসনিক বলাটা বিপণনের ভাষার মতো একটি বিষয়। বস্তুত যেকোনো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকেই এই তকমা দেওয়া যায়।'

কোরিয়ার জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ছবি দেখে ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন, উত্তর কোরিয়া তরলীকৃত জ্বালানি দিয়ে চলে এরকম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে, যেটির সঙ্গে একটি 'ম্যানিউভারেবল রিএন্ট্রি ভেহিকল (মার্ভ)' যুক্ত আছে। গত অক্টোবরে এক প্রতিরক্ষা মেলায় প্রথমবারের মতো ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রদর্শন করা হয়েছিল।

এর আগেও উত্তর কোরিয়া 'মার্ভ' ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। তবে দেশটির জাতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এই নতুন ক্ষেপণাস্ত্রটি গত সেপ্টেম্বরের 'হোয়াসং-৮'র চেয়ে বেশি কার্যকর।

পোলাক আরও জানান, এটি গত বছরের ক্ষেপণাস্ত্রের মতো নয়। এর রয়েছে একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে এটি সীমিত আকারে গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। ফলে এটি আরও নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি সুবিধা পায়।

যদি প্রতিবেদনের তথ্য সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে উত্তর কোরিয়া এ পর্যন্ত ২ ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে গত বছরের 'হোয়াসং-৮' ক্ষেপণাস্ত্র, জানান পোলাক।

হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের উচ্চগতি, গতিপথ পরিবর্তন ও নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষমতা এবং আগে থেকে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি দিয়ে এর গতিপথ বুঝতে না পারার সুবিধাগুলোর কারণেই উত্তর কোরিয়া এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় এত আগ্রহী হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মত দিয়েছেন।

তাদের মতে, এই পরীক্ষাগুলো যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য আঞ্চলিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে পরিচালনা করা হচ্ছে।

ক্যাটো ইনস্টিটিউটের প্রতিরক্ষা নীতিমালা শিক্ষার পরিচালক এরিক গোমেজ বলেন, 'শক্তিশালী ল্যাটেরাল মুভমেন্টের অর্থ হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর গতিপথ আগে থেকে নির্ণয় করা সম্ভব নয়।'

তিনি আরও উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে শব্দের চেয়েও কমপক্ষে ৫ গুণ দ্রুত গতিতে গ্লাইডিং (ভেসে) করে এগিয়ে যাওয়ার সময় একাধিকবার গতিপথ পরিবর্তন করে।

'আক্রমণকারী ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সংঘর্ষে যত দ্রুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আক্রমণকারী ক্ষেপণাস্ত্রের উড্ডয়ন পথ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবে, তত দ্রুত তারা সে অনুযায়ী প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে,' যোগ করেন গোমেজ।

'তবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র যেহেতু গতিপথ বদলায়, এ ক্ষেত্রে সেটি কোথায় আঘাত হানবে, তা নির্ণয় করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে,' যোগ করেন তিনি।

এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের অন্যান্য সুবিধার মধ্যে রয়েছে এর রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা। আকাশের বেশ নিচু স্তর দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রচলিত প্রযুক্তিতে তৈরি বেশিরভাগ রাডারকেই ফাঁকি দিতে সক্ষম।

কয়েকজন বিশ্লেষক বলেছেন, হাইপারসনিক বুস্ট-গ্লাইড অস্ত্রগুলো ভবিষ্যতের সম্ভাব্য যেকোনো যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। এ পরিস্থিতিতে উত্তর কোরিয়ার এ ধরনের অস্ত্র তৈরিকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে নির্বাচন করা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।

এর আগে কিম জং উন তার রাজনৈতিক দলের অষ্টম কংগ্রেস সভায় 'কৌশলগত সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার' ওপর জোর দিয়েছিলেন। ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাগুলোকে এই কৌশলের অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে কেসিএনএ'র প্রতিবেদনে।

কেসিএনএ আরও জানায়, উত্তর কোরিয়ার ৫ বছর মেয়াদী জাতীয় পরিকল্পনার শীর্ষ ৫ কর্মসূচির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিগুলোর সাফল্য নির্ভর করছে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ওপর।

উত্তর কোরিয়ার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নও থাকলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আগামীতে দেশটি আরও পরীক্ষা চালাবে।

কার্নেগি এডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো অঙ্কিত পান্ডা বলেন, 'তারা ইতোমধ্যে ২টি পৃথক হাইপারসনিক গ্লাইডার নকশা পরীক্ষা করেছে। আমার ধারণা, এবারের গ্লাইডারটি আগের 'হোয়াসং-৮' এর চেয়ে সার্বিকভাবে বেশি উপযোগিতা দেখিয়েছে।'

'আমার মনে হয় না এখনো উত্তর কোরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজে লাগাতে পারবে। তারা ২০২২ সাল জুড়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকবে এবং খুব সম্ভবত ২০২৩ সালের আগে তারা একে সক্রিয়ভাবে তাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে না', যোগ করেন অঙ্কিত।

তবে গোমেজসহ কয়েকজন বিশ্লেষক ভাবছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় উত্তর কোরিয়া পরীক্ষা চালানোর পাশাপাশি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে দেরি করবে না।

গোমেজ মতে, খুব সম্ভব সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং কোনো প্রক্রিয়া নিখুঁত হওয়ার আগে প্রতিরোধক হিসেবে সেটাকে ব্যবহার করার চিন্তাধারা থেকে তারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

তিনি মনে করেন, তাদের অস্ত্রগুলো কাজ করে না বা তাদের কাছে এ ধরনের কোনো অস্ত্র নেই—এ ধরনের ভুল ধারণা রাখার চেয়ে তাদের অস্ত্র আছে এবং তা যেকোনো সময় তারা কার্যকর করতে পারে, সেই ভুল করা বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Pathways to the downfall of a regime

The erosion in the credibility of the Sheikh Hasina regime did not begin in July 2024.

7h ago