আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা ও মানবিক সংকটের আশঙ্কা

(বাম থেকে ডানে) মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক শাহাব এনাম খান। ছবি: সংগৃহীত

তালেবানদের ক্ষমতা দখলের ঘটনায় কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা ও মানবিক সংকটের আশঙ্কা করছেন। এর প্রভাব সমগ্র অঞ্চলে পড়তে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। আফগানিস্তানের তালেবান শাসন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জঙ্গিদের অনুপ্রাণিত করবে বলেও তারা মনে করছেন।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পর তালেবানরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রেক্ষাপটে তারা এ মন্তব্য করেন।

অপরদিকে, খনিজ পদার্থে ভরপুর দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে বিশ্বের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলো কৌশলগত কারণে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতায় নামবে। তবে, তা নির্ভর করবে কীভাবে তালেবানরা নিজেদেরকে উপস্থাপন করছে তার ওপর।

তারা চাইলে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে। কিংবা আগ্রাসী হয়ে কঠিন পন্থা অবলম্বন করে তাদের গতবারের শাসনামলের মত (১৯৯৬-২০০১) শরিয়া আইন চালু করতে পারে। আল-কায়েদা ও আইএআইএসের সঙ্গে তারা যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়।

প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি পালিয়ে যাওয়ার পর তালেবানরা গত রোববার মোটামুটি বিনা বাঁধায় আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর থেকে তালেবান ও আফগান নেতারা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা করছেন। দেশটির সরকারের কাঠামো এখন কেমন হবে সেটিও পরিষ্কার নয়।

তালেবানরা তাদের আগের শাসনামলে হত্যা ও ব্যভিচারের দায়ে প্রকাশ্যে ফাঁসি এবং চুরির দায়ে অভিযুক্তদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলার মত শাস্তির প্রচলন করেছিল।

পুরুষদের দাড়ি রাখা ও মহিলাদের সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখার উপযোগী বোরখা পরা আবশ্যক ছিল। নারীদের স্কুলে যাওয়া ও কাজ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।

তালেবানরা টেলিভিশন, সঙ্গীত ও সিনেমা নিষিদ্ধ করেছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের অভিযোগ এসেছিল।

এখন তারা নিজেদেরকে একটি মধ্যপন্থী সংগঠন হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। তারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা ও আইএস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারপরেও তালেবান শাসনের ভয়ে হাজারো আফগান নাগরিক নিয়মিত ও অনিয়মিত প্রক্রিয়ায় দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে পালিয়ে যাচ্ছেন।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালেবানরা আফগান নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ করা ছাড়াও, ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার হামলার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় এবং তালেবানদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে।

দেশটিতে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তিন লাখ আফগান সেনাদের প্রায় ২০ বছর ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারপরেও তারা খুব সহজেই তালেবানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং তালেবানরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আফগানিস্তান দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা ও গৃহযুদ্ধের ঝুঁকিতে আছে।'

'প্রথমত, দেশটিতে অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় আছে যারা তালেবানদের শাসন মেনে নেবে না। এছাড়াও, যেসব আফগান সৈন্য বা গোত্র প্রধান পালিয়ে গেছেন বা আত্মসমর্পণ করেছেন, তারাও বাইরের কোন শক্তির মদদে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে তালেবানদের বিরোধিতা করতে পারে,' বলেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহার করায় দেশটিতে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হবে এবং আফগানিস্তানে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর পুনর্বিন্যাস হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

চীন ইতোমধ্যে তালেবানদের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছে। ১৯৭৯-৮৯'র আফগান-রাশিয়া যুদ্ধে আফগান মুজাহিদীনদের কাছে পরাজিত রাশিয়াও চীনের সঙ্গে থাকবে।

আ ন ম মুনীরুজ্জামান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র ভারতের আফগানিস্তানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও, তালেবান বিরোধী অবস্থানের কারণে তাদের সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।

'আফগানিস্তানের ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যমানের খনি আছে। তালেবানদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রেখে চীন চেষ্টা করবে এই খনিজ সম্পদগুলো আহরণ করার। রাশিয়া ও তুরস্কও চেষ্টা করছে আফগানিস্তানে তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে একটি মৈত্রীর ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ, আফগানিস্তানকে ঘিরে বেশ বড় ধরণের কিছু ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন আসবে সামনে', বলেন মুনীরুজ্জামান।

তিনি আরও জানান, পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানদের সুসম্পর্ক আছে। যদি, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের তালেবানরা একতাবদ্ধ হয়ে ভারতের কাশ্মীরীদের পক্ষ নেয়, সেক্ষেত্রে কাশ্মীরে গোলযোগের সৃষ্টি হতে পারে।

এছাড়াও, আফগানিস্তানে প্রশিক্ষিত অসংখ্য বাংলাদেশি জঙ্গি তালেবানদের উত্থানে অনুপ্রাণিত হয়ে সংঘবদ্ধ হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

'সুতরাং আমরা সমগ্র অঞ্চলে জঙ্গিবাদের মাত্রা বাড়ার ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছি', যোগ করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের আগে থেকেই দক্ষিণ এশিয়া নিরাপত্তা ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চল ছিল এবং আগামীতে সেখানে অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ঝুঁকি আরও বাড়বে।'

'এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি দেশ আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরণের অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাবে', বলেন তিনি।

'এমনকি বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যেও সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা আফগানিস্তানে শক্তিশালী বাহিনীদের প্রবেশ করতে ও বের হয়ে যেতে দেখেছি। এছাড়াও, সেখানে মার্কিন ও পশ্চিমা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিল। অপরদিকে, চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরান ইতোমধ্যে দৃশ্যপটে প্রবেশ করেছে।'

আফগানিস্তান মূলত একটি প্রক্সি রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করবে, যেখানে বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্ররা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, 'বর্তমানের তালেবান অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে এবং তারা একটি জঙ্গি সংগঠন নয়। বরং, শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করছে।'

'এ কারণেই, তালেবানরা দেশটির সকল গোত্র ও সম্প্রদায়ের মতামত ও প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে তৈরি একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নিজেদেরকে ব্র্যান্ডিং করছে,' বলেন তিনি।

'তবে, এখনও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ঘোলাটে' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তালেবানকে সব গোত্রের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করার আগে দেশটির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যকার স্থিতিশীলতার পরিস্থিতি কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে।'

তালেবান প্রসঙ্গে বাংলাদেশের আচরণ কী হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুনীরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং দেশ থেকে যেন জঙ্গিরা কোনোভাবে আফগানিস্তানে যেতে না পারে, সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে।'

বাংলাদেশের জঙ্গিদের ওপর সাইবার পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়াকে আরও মজবুত করার পরামর্শ দেন তিনি।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) আফগানিস্তানের আর্থসামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। এই সংস্থাগুলোর কাজের পরিধিকে ভবিষ্যতে আরও বাড়ানো যেতে পারে।'

'যদিও, সার্ক বর্তমানে প্রায় অকার্যকর অবস্থায় আছে, তবুও সংস্থাটি সামনে এগিয়ে এসে জঙ্গিবাদের মত বিষয়গুলোকে দমন করার জন্য আঞ্চলিক উদ্যোগ নিতে পারে,' যোগ করেন মুনীরুজ্জামান।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

6h ago