‘এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে’
বয়স ৯০। বন্ধু-স্বজন সবাই পরপারে। শুধু বেঁচে আছে স্মৃতি—বেদনাবিধুর। বেঁচে আছে আশা—নিরাশায় ভর করেও।
'চেয়েছিলাম পরিবারের সঙ্গে এই মুহূর্তটি উপভোগ করবো। সবাই চলে গেছেন। তবুও এখানে আসতে পেরে খুশি। যদিও আজ আমি নিতান্তই একা'—কথাগুলো বলছিলেন রিনা ভার্মা।
প্রায় ৭৫ বছরের বিচ্ছিন্নতা শেষে অবশেষে ৯০ বছর বয়সী এই নারী পা রাখলেন রাওয়ালপিন্ডির পুরনো বাড়িতে। শহরটি এখন পাকিস্তানে আর দেশভাগের কারণে এখন তিনি ভারতের নাগরিক।
প্রিয় বাড়িটি দেখার বাসনা দীর্ঘ ৭৫ বছর বুকে ধারণ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন রিনা ভার্মা। গত বছর এক সাক্ষাৎকারে 'নিজের বাড়ি দেখার কাতরতা প্রকাশ করে' তিনি ভারত-পাকিস্তানে 'সোশ্যাল মিডিয়া সেনসেশন' হয়ে উঠেন।
আজ শুক্রবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, গত বুধবার রিনার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ হয়। সেদিন তিনি ভারতের পুনে থেকে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে আসেন।
শহরের কলেজ রোডে পৌঁছালে পথে গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়। বাজে ঢাক-ঢোল। হয় আনন্দ-নাচ। তাকে দেখতে ভিড় জমায় আশপাশের মানুষ।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের উত্তেজনায় রিনার পরিবার রাওয়ালপিন্ডি ছাড়ে। সেসময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সারা দেশের মতো ক্ষতবিক্ষত হয় পাঞ্জাব। লাখো ভুক্তভোগীর মতো তাদেরকেও ঘর ছাড়তে হয়। ছোটবেলার সেই ভয়াবহ দুঃস্মৃতি নিয়েও রিনা ভুলতে পারেননি তাদের সেই বাড়ির কথা। কষ্টের আয় থেকে অর্থ জমিয়ে তার বাবা বাড়িটি তৈরি করেছিলেন।
সেই সাক্ষাৎকারের পর ফেসবুক গ্রুপ ইন্ডিয়া-পাকিস্তান হেরিটেজ ক্লাবের সদস্যরা রাওয়ালপিন্ডিতে রিনাদের বাড়ি খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে এক সাংবাদিক তা খুঁজে পান। কিন্তু, করোনা মহামারির কারণে গত বছর তিনি সেখানে যেতে পারেননি।
গত মার্চে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করলে কোনো কারণ না দেখিয়েই তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। রিনা গণমাধ্যমকে বলেন, 'এ ঘটনায় খুবই বিব্রত হয়েছিলাম। ৯০ বছর বয়সী একজন মৃত্যুর আগে শুধু তার বাড়ি দেখার বাসনা নিয়েও প্রত্যাখ্যাত হতে পারে—তা ভাবতেও পারিনি। কিন্তু, তাই হয়েছে।'
তিনি আবারো আবেদনের সিদ্ধান্ত নেন। এর আগেই তার জীবনকাহিনি জেনে পাকিস্তানের এক মন্ত্রী নয়াদিল্লিতে হাইকমিশনকে দ্রুত রিনার আবেদন বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেন।
'পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে ফোন পেয়ে ভীষণ অবাক হই। আমাকে দেখা করে ভিসা নিতে বলা হয়। এরপর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যায়,' যোগ করেন রিনা।
তবে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় আবহাওয়া। প্রচণ্ড গরমে যেন পুড়ছে গোটা অঞ্চল। তবুও অদম্য রিনা। সম্প্রতি, ছেলে মারা যাওয়ায় তিনি একাই রাওয়ালপিন্ডি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আরও কয়েক মাস অপেক্ষার কথা বলা হলে তিনি বলেন, এটি আরও বেশি 'যন্ত্রণাদায়ক'। তবে প্রচণ্ড গরমে যেন অসুস্থ হয়ে না যান তাই তাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল বটে। সেই অপেক্ষার শেষ হয় গত ১৬ জুলাই।
গত ২০ জুলাই রিনা তাদের পুরনো বাড়িতে যান। পরনে ছিল রঙিন পোশাক। তার উজ্জ্বল কানের দুলের মতোই জ্বল জ্বল করছিল চোখ ২টি।
লেবুর শরবতে চুমুক দিয়ে বিবিসির সংবাদদাতা শুমাইলা জাফরিকে নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে রিনা বলেন, 'এর স্বাদ অম্ল-মধুর!'
একসময় জীবন সুন্দর ছিল
রাওয়ালপিন্ডির সেই পুরনো বাড়ির সামনে স্থানীয় সাংবাদিকদের রিনা বলেন, 'বাড়িটি এখনো দেখতে ঠিক তেমনি আছে। এটি যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে—একসময় আমাদের জীবন সুন্দর ছিল। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও, এখানে আসতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে। সবার কাছে কৃতজ্ঞ।'
'রাওয়ালপিন্ডির বাড়ির পরিবর্তে ভারতে আমাদের যে বাড়ি দেওয়া হয়েছিল মা তা মেনে নিতে পারেননি। তিনি মনে করতেন, যদি এই নতুন বাড়ি মেনে নেওয়া হয় তাহলে সেই পুরনো বাড়ির দাবি আর কোনদিন করা যাবে না।'
'মা ছাড়া আমাদের পরিবারের সবাই দেশভাগ একরকম মেনেই নিয়েছিল।… প্রথমে আমরা ব্রিটিশরাজের অধীনে ছিলাম। এখন আসবে মুসলিমরাজ। কিন্তু, আমাদের জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে কেন?'
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, রিনার এই উৎসাহব্যঞ্জক সফরের ঘটনায় ভারত-পাকিস্তানে অনেকেই ভাবছেন দেশ ২টির রাজনীতিতে একে অপরের প্রতি যতই ঘৃণা ছড়ানো হোক না কেন, ২ দেশের মানুষ আসলে একে অপরের প্রতি অনেক শ্রদ্ধাশীল। অনেক কাছের।
গুগল ঘেঁটে জানা গেল পুনে থেকে রাওয়ালপিন্ডির দূরত্ব ১ হাজার ৬৭৪ কিলোমিটার। তবে ২ দেশের সীমানায় কাঁটাতার দেওয়ার আগে তারা কাছাকাছি ছিল, ছিল পাশাপাশি।
Comments