চীনের বন্ধুতাকে স্বাগত: তালেবান

আফগানিস্তানে কাবুলের একটি চেক পয়েন্টে নজরদারী করছে আফগান ন্যাশনাল আর্মি। ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তান পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় চীনের বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে তালেবান। সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহিন জানান, দেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তারা চীনের বিনিয়োগের উদ্যোগকে স্বাগত জানাবেন।

শাহিন জানান, বর্তমানে দেশের ৮৫ শতাংশ এলাকা তালেবানদের দখলে আছে। তারা চীনের বিনিয়োগকারী ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। এর আগে, আফগানিস্তানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া চীনের বিচ্ছিন্নতাবাদী উইঘুর যোদ্ধাদের তাদের দেশে আর প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আল-কায়েদা কিংবা অন্য কোনো  দল যেন আফগানিস্তান থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে, সে বিষয়টিও তারা নিশ্চিত করবেন।

টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের স্বাগত জানাই। যদি, তাদের বিনিয়োগের পরিকল্পনা থাকে, তাহলে আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।’

সাক্ষাৎকারটি এমন সময়ে প্রকাশ করা হয়েছে যখন তালেবানরা আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার কার্যক্রম প্রায় শেষদিকে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ধারণা করছে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাবুলের ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রায় ২০ বছর পরে আবার তালেবানরা আফগানিস্তানের শাসনভার দখল করতে যাচ্ছে।

সন্ত্রাসী দল আল-কায়েদা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন শহর আক্রমণ করার পর যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে তালিবানরা আল-কায়েদাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং এর ফলশ্রুতিতে তারা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে।

শাহিন বলেন, ‘মার্কিন সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী রাষ্ট্র চীনের সঙ্গে আলোচনায় বসা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা অনেকবার চীনে গিয়েছি এবং তাদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক আছে। চীন একটি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্র এবং আমরা আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য তাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি।’

উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে বিশ্বের বৃহত্তম অবিকৃত খনিজ পদার্থের আঁকর আছে। সেখানে আছে তামা, কয়লা, লোহা, গ্যাস, কোবাল্ট, পারদ, সোনা, লিথিয়াম ও থোরিয়ামের খনি। এসবের আনুমানিক মূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

২০১১ সালে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (সিএনপিসি) ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে নিলাম জয়লাভ করে ২৫ বছরের জন্য তিনটি তেলের খনি খনন করার অনুমতি পেয়েছিল, যেখানে আনুমানিক ৮৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আছে।

এছাড়াও, চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো রাজধানী কাবুল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লোগার প্রদেশের মেস আয়নাকে তামা খনন করার অনুমতি পেয়েছিল।

তবে, ১৯৯০ সালের দিকে ‘গেরিলা বিদ্রোহ’ ঘটানোর উদ্দেশ্যে চীন থেকে আফগানিস্তানে পালিয়ে যাওয়া উইঘুরদের একটি দলের ব্যাপারে দেশটির অভিযোগ রয়েছে। চীন ‘ইস্ট তুর্কেস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম)’ নামের দলটিকে শিনজিয়াং অঞ্চলের পশ্চিম প্রদেশের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য দায়ী করে।

তবে শাহিন এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছি, অন্য দেশের নাগরিক বা কোন গোত্র যদি আফগানিস্তানকে চীন সহ অন্য যেকোনো দেশকে আক্রমণ করার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে চান, তাহলে আমরা তা প্রতিহত করবো।’

‘দোহা চুক্তি অনুযায়ী এটি আমাদের অঙ্গীকার। আর আমরা সে চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল’, বলেন শাহিন।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালিবানদের স্বাক্ষর করা শান্তি চুক্তিটিকে ‘দোহা চুক্তি’ বলা হয়। এই চুক্তির ফলশ্রুতিতে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পথ তৈরি হয়।

ইটিআইএমের ব্যাপারে আলাদা করে প্রশ্ন করা হলে শাহিন নিশ্চিত করেন, ‘হ্যাঁ, তাদেরকে আমরা প্রবেশ করতে দেব না।’

তিনি আরও জানান, আল-কায়েদা অতীতের বিষয় এবং তাদেরকে এই দেশে আর কখনও কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না। তিনি দাবি করেন আফগানিস্তানে বর্তমানে আল-কায়েদার আর কোনো সদস্য নেই।

গবেষক এবং চীনের বৈদেশিক নীতিমালা বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র ট্র্যান্সঅ্যাটলান্টিক ফেলো অ্যান্ড্রু স্মল বলেন, তালেবানদের সঙ্গে চীনের সম্পর্কটি অনেক পুরনো। তালেবানরা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত দেশটি শাসন করার সময় থেকেই এই সম্পর্কটি টিকে আছে.

তিনি বলেন, ‘আমি অনেক বছর আগে এ ব্যাপারে লিখেছিলাম, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করার পরেও পাকিস্তানে গোপন বৈঠকগুলো হচ্ছিল। তখনও তালেবানদের সঙ্গে অন্যান্য দেশের স্বাভাবিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’

তিনি বলেন, 'চীন তালেবানদের সঙ্গে কূটনীতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে ‘বন্ধু’ হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।'

তবে, এখন চীন ‘নতুন করে দেশটিতে বিনিয়োগ করতে বা তাদের প্রতি কোন ধরণের অঙ্গীকার করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করবে’, জানান তিনি।

তিনি জানান, চীনের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের উৎস উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। চীনের ধারণা, তালেবানরা তাদেরকে ১৯৯০ সালে দিকে আশ্রয় দিয়েছিল।

তবে ২০১৩ সালে তালেবানদের প্রয়াত নেতা মোল্লাহ ওমরের সঙ্গে উইঘুরদের ব্যাপারে একটি সমঝোতা হয়েছিল, জানান স্মল।

বেইজিং এখনও সন্দিহান, সে সমঝোতার কতটুকু তালেবানের বর্তমান নেতৃবৃন্দ মেনে চলবেন, কিংবা চলতে পারবেন। এছাড়াও, বেইজিং তাদের নিজেদের অঞ্চলের নিরাপত্তা ঝুঁকির ব্যাপারেও চিন্তিত, কারণ শিনজিয়াং অঞ্চলে দুই দেশের মধ্যে একটি ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।

গত বৃহস্পতিবারে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই জানান, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো চীন ও পাকিস্তান উভয়ের জন্য ঝামেলাপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, ‘চীন ও পাকিস্তান উভয়েই আফগানিস্তানের সংশ্লিষ্ট সকল গোষ্ঠীকে সহায়তা করতে ইচ্ছুক, যাতে আলোচনার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো যায় এবং সকল গোত্রের সহাবস্থানের মাধ্যমে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।’

এদিকে পেন্টাগন জানিয়েছে মার্কিন বাহিনীর প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর সহায়তা না থাকায় আফগান সরকারি বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে এবং সৈন্যরা তাদের নির্ধারিত অবস্থান ছেড়ে পিছিয়ে যাচ্ছে অথবা পার্শ্ববর্তী দেশ, যেমন তাজিকিস্তানে পালিয়ে যাচ্ছে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক ও বর্তমান সদস্যরা মনে করছেন আফগান সেনাবাহিনী খুবই দুর্বল এবং কাবুল সরকারের টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কমে।

তালেবানদের আবারো ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনায় দেশের নারীদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তারা ভাবছেন তাদের ওপর অত্যাচার নেমে আসবে, তাদেরকে কাজ করতে দেওয়া হবে না এবং কম বয়সীদের স্কুলে যেতে দেওয়া হবে না। মানবাধিকার সংস্থার সদস্যরা দাবি করেছেন, উত্তরের বিভিন্ন এলাকা দখল করে তালেবান বিদ্রোহীরা বিভিন্ন মানুষকে তাদের বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। তারা নারীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

তবে শাহিন আশ্বস্ত করেন, মেয়েদেরকে স্কুলে যেতে দেওয়া হবে। ‘আমরা যে জেলাগুলো দখল করেছি, সেখানে সব স্কুল খোলা আছে এবং মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে’, বলেন তিনি।

তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানান শিক্ষক, ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য আর্থিক সহযোগিতা করতে।

তিনি জানান, ‘আমাদের দখলে থাকা এলাকাগুলোতে কাবুল সরকার কর্মীদের বেতন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’

Comments

The Daily Star  | English
bangladesh bank buys dollar

BB buys $313m more from 22 banks

Bangladesh Bank purchased another $313 million from 22 commercial banks in an auction yesterday, reacting to the sharp drop in the US dollar rate.

4h ago