কেন সাংবাদিক জুবায়ের এত গুরুত্বপূর্ণ, কেন গ্রেপ্তার?

‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও বিদ্বেষ ছড়ানোর’ অভিযোগে ভারতের অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করেছে নয়াদিল্লি পুলিশ। তবে ভারতের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষকরা মনে করছেন যে কারণ দেখিয়ে জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
মোহাম্মদ জুবায়ের। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও বিদ্বেষ ছড়ানোর' অভিযোগে ভারতের অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করেছে নয়াদিল্লি পুলিশ। তবে ভারতের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষকরা মনে করছেন যে কারণ দেখিয়ে জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক।

তারা বলছেন, ভারত সরকার যখন বিশ্ব মঞ্চে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলেন, বৃহৎ গণতন্ত্রের কথা বলেন তখন নিজ দেশেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত।

ভারতের ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়েরকে গত সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করে ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

জুবায়েরকে গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপট

মোহাম্মদ জুবায়ের ২০১৮ সালে 'কিসি সে না কেহনা' ছবির একটি স্টিল ফটো টুইট করে লেখেন ২০১৪ সালের আগে ছিল 'হানিমুন হোটেল' ২০১৪ সালের পর হয়েছে 'হনুমান হোটেল'।

২০১৪ সালে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ক্ষমতায় আসে।

ভারতের গণমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, জুবায়েরের সেই টুইট করা ছবির উল্লেখ করে গত ১৯ জুন '@বালাজিকিজৈন' নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে 'হনুমান ভক্ত' নামের এক ব্যক্তি ২০১৮ সালের পোস্টের কথা উল্লেখ করে টুইট করেন, সৃষ্টিকর্তাকে অপমান করার জন্য জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করা উচিত। সেই পোস্টে দিল্লি পুলিশকে ট্যাগ করা হয়।

যে টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল সেটিতে মাত্র একটি পোস্ট ছিল এবং ফলোয়ারও মাত্র একজন ছিল। তবে গতকাল বুধবার সেই টুইটার অ্যাকাউন্টের আর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দিল্লি পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, ওই ব্যক্তি তার অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দিয়েছেন। তবে এটা আমাদের তদন্তে কোনো প্রভাব ফেলবে না। জুবায়েরের পুরোনো টুইটটি অনেক প্রচার হয়েছে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে বলে আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। আমরা অভিযোগকারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি এবং তাকে অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করব। তিনি সম্ভবত ভয় পাওয়ার কারণে অ্যাকাউন্টটি মুছে ফেলেছেন।

জুবায়েরের সহকর্মী প্রতীক সিনহা ২৭ জুন রাত ৮টা ৩২ মিনিটে এক টুইট বার্তায় জানান, '২০২০ সালের পুরোনো একটি মামলায় জুবায়েরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল ডেকে পাঠায়। যদিও এই মামলায় হাইকোর্ট তাকে আগেই গ্রেপ্তার না করার আদেশ দিয়েছেন। তবে আমরা আজ সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে জানতে পেরেছি অন্য একটি এফআইআরের ভিত্তিতে জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।'

জুবায়ের এত আলোচিত কেন

ভারতের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা জুবায়ের ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টেলিকম জায়ান্ট নকিয়ার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করেছেন। ২০১৭ সালে তিনি এবং গুজরাটের আহমেদাবাদের আরেকজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার প্রতীক সিনহা মিলে অল্ট নিউজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম বছর অল্ট নিউজের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল প্রতীক সিনহার ওপর। নকিয়ায় কাজ করার পাশাপাশি প্রতীককে নানাভাবে সহায়তা করতেন জুবায়ের। ২০১৮ সালে তিনি অল্ট নিউজে একজন পূর্ণকালীন কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

অল্ট নিউজ মূলত একটি ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট। বিভিন্ন সময়ে ভারতে নানা বিষয়ে যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে অল্ট নিউজ সেগুলোর সত্যতা যাচাই করে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে।

ভারতের সংবাদমাধ্যম ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা বলছেন, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন ভুয়া তথ্য যাচাই করে তথ্য প্রকাশ করে অল্ট নিউজ। এই ফ্যাক্ট চেকিং কাজে মূলত জুবায়েরের অবদান অনেক বেশি। তিনি সবসময় সত্য তুলে ধরেন। এই সত্য তুলে ধরার কারণে অনেক দিন ধরে ভারতের ক্ষমতাসীন দল তার উপর নাখোশ ছিল।

অল্ট নিউজের পাশাপাশি জুবায়ের ভারতের মুসলিমদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। সম্প্রতি বিজেপির বহিষ্কৃত নেত্রী নূপুর শর্মা টেলিভিশনের মহানবী (সা.) বিষয়ে যে অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন জুবায়ের প্রথম সেই বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন।

 যা ভাবছে ভারতের সাংবাদিক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা

ভারতের চেন্নাইয়ে খ্যাতিমান সাংবাদিক ও বর্তমানে এশিয়ান কলেজ অব জার্নালিজমের নিউ মিডিয়ার অধ্যাপক কল্যাণ অরুন আজ বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জুবায়ের নূপুর শর্মার বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন। এই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে আরব দেশগুলোতে সংকটে পড়ে ভারত। জুবায়েরকে আটকের পেছনে এটি একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হলো জুবায়ের বিজেপি নেতাদের  অসত্য এবং গুজব ফ্যাক্ট চেকিংয়ের মাধ্যমে সত্য তথ্য তুলে ধরেছেন। এতে  বিজেপি সরকারের তার ওপর এক ধরনের ক্ষোভ থাকতে পারে।'

সাংবাদিকতার এই শিক্ষক বলেন, 'জুবায়ের ভারতে নিজেই একজন সংখ্যালঘু এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন। যা অনেকেরই পছন্দ নয়। এটিও তাকে গ্রেপ্তারের একটি কারণ হতে পারে। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং মতপ্রকাশের পরিপন্থী।'

কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আন্তর্জাতিক মঞ্চে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছেন অথচ নিজ দেশেই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তিনি বৃহৎ গণতন্ত্রের কথা বলছেন অথচ নিজ দেশেই গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না। ২০১৮ সালের ঘটনায় জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করা অত্যন্ত দুঃখজনক।'

কলকাতার সাংবাদিক ও লেখক শান্তনু দে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেদিন জার্মানিতে জি-৭ ও সহযোগী ৫ দেশের মধ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার সনদে সই হলো এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেখানে স্বাক্ষর করলেন সেদিনই জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করা হলো। সনদে স্পষ্ট বলা আছে, "অনলাইন এবং অফলাইন উভয় ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রাখতে নেতারা ঐক্যবদ্ধ হবেন। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন ও মুক্ত রাখার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়ার কথাও হয়েছে।" এটি জি-৭ সনদের মূল কথা।'

তিনি বলেন, 'যে মামলায় জুবায়েরকে থানায় ডাকা হয়েছিল সে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়নি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরেকটি মামলায়। ২০১৮ সালের একটি পোস্ট নাকি পুলিশের নজরে এসেছে। পুলিশের এক কনস্টেবলের "ভাবাবেগে" তা আঘাত করেছে। ২০১৮ সালের পোস্টটি ছিল ১৯৮৩ সালের পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জির 'কিসি সে না কেহনা'র একটি কমিক দৃশ্য। যে তথ্য যাচাইয়ের একটি ওয়েবসাইট চালায় এবং ভুয়া সংবাদ ফাঁস করা যার কাজ সে আজ জেলে। তবে "যে" ভাবাবেগকে আহত করেছে সে আজও জেলের বাইরে। আমি নাম বলছি না "যে" শব্দটাই বলছি। সেই "যে" টেলিভিশন চ্যানেলে প্রকাশ্যে অবমাননাকর কথা বলেছিলেন। জুবায়ের তা পোস্ট করেছিল। এটিই হলো পরিস্থিতি।'

প্রখ্যাত এই সাংবাদিক ও লেখক বলেন, 'গণমাধ্যম সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভারতের মত প্রকাশের স্বাধীনতা কমছে। এখন আমাদের অবস্থান ১৫০। গত বছর ছিল ১৪২। বাক স্বাধীনতা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সত্য অনেক ভারী। তাই সত্য কথা বললেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে।'

জুবায়েরের অ্যাকাউন্টে ৫০ লাখ রুপি জমার অভিযোগ

ইন্ডিয়া টুডের সংবাদে দিল্লি পুলিশের সাইবার ইউনিটের বরাত দিয়ে বলা হয় জুবায়েরের অ্যাকাউন্টে গত ৩ মাসে প্রায় ৫০ লাখ রুপি এসেছে। পরবর্তীতে ইন্ডিয়া টুডে তাদের সংবাদের শিরোনাম ৩ মাসের পরিবর্তে লিখেছে কিছুদিনের মধ্যে জুবায়েরের অ্যাকাউন্টে ৫০ লাখ রুপি এসেছে। তবে এই রুপির কোনো সোর্স জানা যায়নি। যদিও ইন্ডিয়া টুডে এই বিষয়ে জুবায়েরের সহকর্মী বা আইনজীবীর সঙ্গে কোনো কথা বলেনি।

নিউজলন্ড্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অল্ট নিউজের চিফ প্রতীক সিনহা এক টুইট বার্তায় বলেছেন, পুলিশ মিথ্যা বলছে। যে টাকা লেনদেন হয়েছে তা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে। কোনো ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে নয়।

ভারতের আরেক সংবাদমাধ্যম রিপাবলিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এই ৫০ লাখ রুপি বিষয়ে জুবায়েরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ডেকেছিল কিন্তু জুবায়ের কোনো সহযোগিতা করেনি। প্রতীক সিনহা এই বিষয়টিও অস্বীকার করেছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক কল্যাণ অরুন বলেন, '৫০ লাখ টাকা জমার বিষয়টি শুধু পুলিশের ভাষ্য। এর কোনো ডকুমেন্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি।'

সাংবাদিক ও লেখক শান্তনু দে একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, 'এই বিষয়টি পুলিশ পরিষ্কার করে বলতে পারবে। তবে তাকে মূলত যে কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেটি কেউ মুখে বলতে না চাইলেও অনেকটা পরিষ্কার।'

Comments

The Daily Star  | English
Civil society in Bangladesh

Our civil society needs to do more to challenge power structures

Over the last year, human rights defenders, demonstrators, and dissenters have been met with harassment, physical aggression, detainment, and maltreatment by the authorities.

8h ago