ভারত

চলে গেলেন ‘এক টাকার ডাক্তার’ সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়

কারও কাছে তিনি 'গরিবের ডাক্তার', অন্য কারো কাছে 'এক টাকার ডাক্তার'। মাত্র এক টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চিকিৎসা দেওয়ায় তিনি সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন 'এক টাকার ডাক্তার' নামে।
ডা. সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়

কারও কাছে তিনি 'গরিবের ডাক্তার', অন্য কারো কাছে 'এক টাকার ডাক্তার'। মাত্র এক টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চিকিৎসা দেওয়ায় তিনি সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন 'এক টাকার ডাক্তার' নামে।

১৯৬৩ সাল থেকে প্রায় ছয় দশক নামমাত্র পারিশ্রমিকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তবু দরিদ্র সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করেননি। মহামারির পুরো সময়ে নিয়ম করে সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত রোগী দেখেছেন।

তার সব ব্যস্ততার শেষ হলো অবশেষে। আজ মঙ্গলবার সকাল ১১ টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি চিকিৎসক। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

গত কয়েক মাস ধরেই বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থতায় ভুগছিলেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। গত বছরের এপ্রিলে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন বেশ কিছুদিন তার চেম্বার বন্ধ ছিল। সুস্থ হয়ে ওঠার পর নিজেকে ফের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত করেন।

সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে। বাবা বিনয়কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বীরভূম জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর। শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয়েছিল তার। কলকাতার রাধা গোবিন্দ কর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্যাথলজির পিজি ডিগ্রিতে স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা নিতে লন্ডনে যান। হেমাটোলজিতে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেওয়ার পর ইংল্যান্ডেই কর্মজীবন শুরু করেন। একপর্যায়ে লন্ডনে মানবতাবাদী বিখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক লরেন্সের সাহচর্যে আসেন সুশোভন। এর কিছুদিনের মধ্যেই অধ্যাপক লরেন্স চিকিৎসা সেবার ব্রত নিয়ে আফ্রিকার দেশ ঘানায় চলে যান।

অধ্যাপক লরেন্সের মতাদর্শে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়কে লন্ডনের নিরাপদ ভবিষ্যৎ, প্রাচুর্য আর বৈভব টানেনি। প্রান্তিক মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে স্বদেশে ফিরে এসে তিনি বোলপুরে পিয়ারসন মেমোরিয়াল হাসপাতালে ডিপুটি চিফ মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। কয়েক মাস পরই চাকরি ছেড়ে বোলপুরের হরগৌরিতলার পৈতৃক বাড়িতে বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত রোগী দেখতেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রথমদিকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিলেও রোগীদের সংকোচের কথা বিবেচনা করে নিজের পারিশ্রমিক ১ টাকা ধার্য করেছিলেন এই বরেণ্য চিকিৎসক। প্রতিদিন প্রায় ২০০ রোগী দেখতেন। নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা সেবা পেতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে বহু দরিদ্র মানুষ ছুটে আসতেন তার বাড়িতে।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ১৯৮০ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৮৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বোলপুর থেকে কংগ্রেসের বিধায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি জৈল সিং তাকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। তিনি আমৃত্যু বিশ্বভারতীর পরিচালনা সমিতির প্রবীণতম সদস্য হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।

সর্বাধিক সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ায় ২০২০ সালে জুলাই মাসে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'লংগেস্ট অ্যাওয়ারনেস রিবন' দিয়েছিল।

আশির দশকে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'ওয়ান রুপি ডক্টর' হিসেবে অভিহিত করলে সর্বমহলে তিনি 'এক টাকার ডাক্তার' নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। ২০২১ সালে ভারত সরকার সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'পদ্মশ্রী' সম্মাননায় ভূষিত করে।

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

5h ago