বিজেপির জয়, কংগ্রেসের পরাজয় ও কেজরিওয়ালের উত্থান

নরেন্দ্র মোদি, সোনিয়া গান্ধী এবং অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: সংগৃহীত

আগামী ২০২৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়া, মণিপুর ও পাঞ্জাব- এই ৫টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। অনেকেই এই নির্বাচনকে সেমিফাইনাল হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

সেমিফাইনালের খেলায় বিজেপির অভাবনীয় সাফল্য এবং কংগ্রেসের পরাজয় ভারতের জাতীয় রাজনীতি নিয়ে অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। কেউ কেউ আবার অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিকে (আপ) কংগ্রেসের বিকল্প এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নরেন্দ্র মোদের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করছেন।

ভারতের ৫টি রাজ্যের নির্বাচনে ৪টিতেই জয়লাভ করেছে বিজেপি। পাঞ্জাবে কংগ্রেসকে হটিয়ে আম আদমি পার্টির জয় ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মোড় নিয়েছে বলে মনে করেছেন বিশ্লেষকরা।

ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচনের ফলাফলে উত্তরপ্রদেশ ৪০৩টি আসনে মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ২৫৫টি। সমাজবাদী পার্টি ১১১টি এবং কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ২টি আসন। উত্তরাখণ্ডে ৭০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৪৭টি এবং কংগ্রেস পেয়েছে ১৯টি আসন। গোয়ায় ৪০টির মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ২০টি, কংগ্রেস ১১টি এবং আম আদমি পার্টি পেয়েছে ২টি আসন। মণিপুরে ৬০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৩২টি এবং কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ৫টি আসন। পাঞ্জাবে ১১৭টি আসনের মধ্যে আম আদমি পার্টি পেয়েছে ৯২টি, কংগ্রেস ১৮ এবং বিজেপি ২টি।

৫টি রাজ্যের মধ্যে ৪টিতে বিজেপি ও তাদের জোট ক্ষমতায় ছিল। ২০১৭ সালের নির্বাচনে ৭৭টি আসন পেয়ে পাঞ্জাবে জয়লাভ করেছিল কংগ্রেস।

দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক ইশান ঘোষ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উত্তরপ্রদেশে বিজেপি তৃণমূলের মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছে। তাছাড়া তাদের নেতৃত্বে নতুনত্ব এনেছে। যা বিজেপিকে জয়ী হতে সাহায্য করেছে। গোয়ায় বিজেপির জয় সবাইকে একটু অবাক করেছে। উত্তরাখণ্ডে এবার বিজেপির আসন কমেছে। আর মণিপুরে বিজেপি অনেক ভালো প্রচারণা চালিয়েছে, ফলে জয় পেয়েছে।'

পাঞ্জাবে কংগ্রেসের হারার কারণ হিসেবে নেতৃত্বের সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কংগ্রেস পাঞ্জাবে হারবে এটা অনেকটা জানাই ছিল। কারণ তাদের নেতৃত্বে অনেক সমস্যা ছিল। ভোটাররা কোনোভাবেই তাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।'

বিজেপির অভাবনীয় সাফল্যের কারণ

ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার সম্পাদকীয় বলছে, ৪টি রাজ্যে বিজেপির সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা। তাছাড়া বিজেপির সমাজের উন্নয়নে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, তাদের দলীয় নেতাদের সমন্বয় এবং জোরালো বক্তব্য নির্বাচনে জয়লাভ করতে সাহায্য করছে। পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টির জয়ের পেছনেও এই কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, কংগ্রেসের নেতৃত্বের সমস্যাকে তাদের ভরাডুবির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী যোগী আদিত্যনাথ প্রায় ৬২ বছর পর দ্বিতীয় মেয়াদে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গোবিন্দবল্লভ পন্থ ১৯৫০ ও ১৯৫৪ সালে এবং সম্পূর্ণানন্দ ১৯৫৪ ও ১৯৬০ সালে পরপর ২ বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তবে তারা ২ জনই ছিলেন কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত। যোগী আদিত্যনাথ ও নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এই জয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছিল, মুদ্রাস্ফীতি, গরু নিয়ে বিতর্ক, করোনার দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং বেকারত্ব নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। কিন্তু তার তেমন কোনো রেশ পাওয়া যায়নি নির্বাচনে। কৃষক আন্দোলনের তেমন একটা প্রভাব পড়েনি এখানে। নির্বাচনের আগে দলিত সম্প্রদায়ের অনেক নেতা সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেটিরও তেমন প্রভাব পাওয়া যায়নি নির্বাচনের ফলাফলে। বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদীরা সমাজবাদী পার্টিকে অপরাধীদের আশ্রয়দাতা এবং যাদব ও মুসলমানদের দল বলা আখ্যা দিয়ে থাকে।

গোয়ায় বিজেপির জয়ের পেছনে মহারাষ্ট্রবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টি কিছুটা হলেও সাহায্য করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এখানে ভোট ভাগাভাগি হয়েছে। তবে কংগ্রেস তুলনামূলক ভালো প্রতিযোগিতা করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিজেপির শক্তিশালী নেতৃত্ব নির্বাচনে জয়ী হতে কিছুটা সহায়তা করেছে। উত্তরপ্রদেশ ভেঙে তৈরি হওয়া উত্তরাখণ্ডে জাতপাতের রাজনীতি গুরুত্ব পেয়েছে। এই রাজ্যের জনবসতির ৫০ শতাংশই উচ্চবর্ণের। যাদের অধিকাংশই আবার বিজেপি সমর্থক বলে পরিচিত। তবে উত্তরাখণ্ডের রাজনীতিকে মোদি ফ্যাক্টর হিসেবে দেখছেন অনেকে। এই রাজ্যটি নেপাল-চীনের সীমানায় অবস্থিত। জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত তাই বরাবরই প্রভাবিত করেছে উত্তরাখণ্ডকে। উত্তরাখণ্ডের ভূমিপুত্র জেনারেল বিপিন রাওয়াতের বিমান দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিতেও ভোলেননি। নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি আক্রমণে গিয়ে মোদি বলেছিলেন, 'যে কংগ্রেস রাওয়াতকে রাস্তার গুণ্ডা বলেছিল, তাদের একটাও ভোট দেবেন না।' উত্তরাখণ্ডে ক্ষমতায় থাকাকালীন গত ৫ বছরে কয়েক বার দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে মুখ্যমন্ত্রী বদলাতে হয়েছে বিজেপিকে। ৫ বছরের শাসনকালে ৩ বার মুখ্যমন্ত্রী বদলানোর কারণে এ রাজ্য নিয়ে আশঙ্কা ছিল বিজেপির। এ কারণে উত্তরাখণ্ড নিয়ে বাড়তি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তবে নির্বাচনে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী পুস্কর সিং ঢালির পরাজয় দলটিকে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।

মণিপুরে বিজেপির জয়ের পেছনে রাজ্যের ফান্ডের জন্য দিল্লির ওপর নির্ভরশীলতার বিষয়টি বড় করে দেখা হচ্ছে। বিজেপি তাদের উন্নয়ন তত্ত্ব এখানে ভালো মতো কাজে লাগিয়েছে। এবারের নির্বাচনে বিজেপি মণিপুরে কোনো আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট করেনি। ফলে তাদের কাছে এবারের নির্বাচন ছিল অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা এন বীরেন সিংহের কাছে। কেননা বিজেপিকে রাজ্যের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ভার তার ওপরেই দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

বিজেপির জয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, 'দেশের ৪ দিক থেকে বিজেপি সমর্থন পেয়েছে। বিজেপির প্রতি মানুষের অপার বিশ্বাসের জয় হয়েছে।'

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে বিজেপির সদর দপ্তর থেকে মোদি বলেছেন, 'গরিবের জন্য কাজ করছে বিজেপি। এতদিন প্রকল্প ঘোষণা হলেও সেই কাজ বাস্তবায়িত হতো না। আমি চাই শতভাগ গরিব মানুষ সব ধরনের সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাক।'

কোনো দিকে কংগ্রেসের রাজনীতি

এতদিন পাঞ্জাবসহ ৩টি রাজ্য কংগ্রেসের দখলে ছিল। বর্তমানে রাজস্থান ও ছত্তিসগড় তাদের দখলে আছে। পাঞ্জাবের আম আদমি পার্টির কাছে কংগ্রেসের হার দলের সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে ভারতের প্রাচীনতম এই দলটি। পাঞ্জাবে কংগ্রেসের ভরাডুবির পেছনে নেতৃত্বের সংকটকেই মুখ্য হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। ভারতের রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিং চান্নি এবং নভজ্যোৎ সিং সিধুর অন্তর্দ্বন্দ্ব কংগ্রেসের খারাপ ফলাফলের অন্যতম বড় কারণ। ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের পদত্যাগের পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের একাংশ মনে করছিল, নভজ্যোত সিং সিধুর হাতেই রাজ্যের দায়িত্ব দিতে পারে কংগ্রেস। তবে তা হয়নি। চরণজিৎ সিং চান্নিকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়েছিল কংগ্রেস।

দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেস বিট কাভার করা সাংবাদিক বর্তমানে ভারতের এশিয়ান কলেজ অব জার্নালিজমের অধ্যাপক কল্যাণ অরুণ বলেন, 'কংগ্রেসের নেতারা নিজেরাই দলকে হত্যা করেছেন। তারা পাঞ্জাবে ভুল লোককে নির্বাচন করেছেন।'

তিনি বলেন, 'কংগ্রেসকে পরাজয় ভুলে গিয়ে তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করতে হবে। গণতান্ত্রিকভাবে দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে। কংগ্রেসের লোকজন নির্বাচনের ৬ মাস আগে শুধু কাজ করে। তাদেরকে সারাবছর জনগণের জন্য কাজ করতে হবে, জনগণের পাশে থাকতে হবে। তাদের দলীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা খুব জরুরি। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।'

আম আদমি পার্টি কি কংগ্রেসের বিকল্প হতে চলছে?

দিল্লির পর পাঞ্জাব এখন আম আদমি পার্টির দখলে। এই জয়ের পর অনেকেই ভাবতে শুরু করেছে, তবে কি কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে জাতীয় রাজনীতি আম আদমি পার্টির আবির্ভাব ঘটছে?

গোয়ায় ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ২টি আসনে জয়ী হয়েছে আম আদমি পার্টি। উত্তরাখণ্ডে কোনো আসন না পেলেও ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছে দলটি। টানা ৩ বারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দিল্লি শাসন করছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনে কেজরিওয়ালের লক্ষ্য হরিয়ানা, রাজস্থান ও গুজরাট।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেজরিওয়াল জনগণের কাছে ধীরে ধীরে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠছেন। যেমন হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কেজরিওয়ালের উন্নয়নের মডেল ভোটারদের ভোট দিতে বাধ্য করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেজরিওয়াল ক্ষমতায় আসার পর দিল্লির স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের অনেক উন্নতি হয়েছে। এই খাত ২টির সফলতাই পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টির সফলতা বয়ে এনেছে।

ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার সাবেক সাংবাদিক শুভব্রত গড়াই দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আম আদমি পার্টি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে নিঃসন্দেহ বলা যায় তারা কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তবে এর জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। সামনে অন্য কোনো রাজ্যে তারা নির্বাচনে কোনো ধরনের ছাপ রাখতে পারবে সেটির ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। তবে তারা যে ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে এটি বলাই যায়।'

দ্য হিন্দু পত্রিকার সম্পাদকীয়তেও বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে আম আদমি পার্টি বিজেপির সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। তবে এর জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। 

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

5h ago