অস্ত্র চোরাকারবারিদের নজরে নির্বাচন ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প

একটি বহুজাতিক সিন্ডিকেট গত ৪ বছর ধরে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অস্ত্র চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত। এই অবৈধ অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা হিসেবে তাদের লক্ষ্য হয় নির্বাচনে সহিংসতাকারী ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সদস্যরা। এমনটিই জানিয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
পুরনো চোরাকারবারি রুটের পাশাপাশি এই সিন্ডিকেট নতুন কিছু রুট ব্যবহার করছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ২০১৮ সালে এ বিষয়ে জানতে পারে।
অন্তত ৩ জন অনুমোদিত অস্ত্র ব্যবসায়ী এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর কিছু সদস্য বাহক হিসেবে কাজ করছেন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট জানিয়েছে, ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর এই সদস্যদের কাছে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে।
দলটি দাবি করেছে, তারা গত মাসের শেষের দিকে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করা ৪ জনকে জেরা করে এই তথ্য জানতে পেরেছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ১ জন অনুমোদিত অস্ত্র ব্যবসায়ী রয়েছেন।
সিটিটিসির অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (এডিসি) আহমেদুল ইসলাম জানান, এই সিন্ডিকেট আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও যশোরের বেনাপোল রুট দিয়ে ভারত থেকে অস্ত্র পাচার করতো।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এই রুটগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করার কারণে সিন্ডিকেট তাদের রুট বদলিয়ে রাঙ্গামাটির বরকল এবং সিলেটের তামাবিল দিয়ে চোরাকারবারি শুরু করে।
আহমেদুল আরও বলেন, 'বেশিরভাগ অস্ত্রই বিহারে তৈরি হয়। সেখান থেকে ত্রিপুরায় চালান পাঠানো হয়। আমরা আরও জানতে পেরেছি কিছু অস্ত্র মিয়ানমারের একটি কারখানায় তৈরি করা হয়েছে এবং সেগুলো মিয়ানমারের মংডু থেকে রাঙ্গামাটিতে পাচার করা হয়েছে।'
তবে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান জানান, অস্ত্র চোরাকারবারির রুট পরিবর্তনের ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিন্ডিকেটগুলো অস্ত্র চোরাকারবারের জন্য একই রুট (যেগুলো আগে ব্যবহৃত হতো) ব্যবহার করে যাচ্ছেন। তবে, বিজিবি সব সীমান্ত পয়েন্টে অস্ত্র চোরাকারবারির বিষয়ে সজাগ রয়েছে।'
সূত্র জানায়, এসব অস্ত্রের বেশিরভাগই অপরাধীদের কাছে সরবরাহ করা হয় এবং পরবর্তীতে সেগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় সহিংসতার সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করা হয়।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমপক্ষে ৩৪ জন মানুষ এ বছর নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন।
ইতোমধ্যে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে গত সোমবার থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। তারা একইসঙ্গে নির্বাচনী সহিংসতার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করার জন্য একটি তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এই অভিযান ৬৪ জেলায় ৭ দিন ধরে চলবে। সূত্ররা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে এই সময়সীমা আরও বাড়ানো হতে পারে।
বিক্রেতা ও বাহক
৩১ অক্টোবর সিটিটিসি ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন—চট্টগ্রামের অনুমোদিত অস্ত্র ব্যবসায়ী মো. হোসেন, রাঙ্গামাটির পাংখোয়া সম্প্রদায়ের নেতা লাল তন পাংখোয়া, মো. আলী আকবর ও মো. আদিলুর রহমান সুজন। তাদেরকে অস্ত্র চোরাকারবারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে রাজধানীর সায়দাবাদ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তারা বর্তমানে কারাগারে আছেন।
তদন্তকারীরা জানান, অনুমোদিত অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকার ঘটনা আগেও ঘটেছে। ২০১৮ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে পুলিশের আর্মস এনফোর্সমেন্ট দল প্রায় ১ ডজন অনুমোদিত অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে এবং প্রায় ২০০টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে।
চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অনুমোদিত অস্ত্র ব্যবসায়ী মো. হোসেন। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, তার সঙ্গে আরও ২ জন অস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন।
এডিসি আহমেদুল বলেন, 'বাকি ২ জন অনুমোদিত অস্ত্র ব্যবসায়ীর সব বৃত্তান্ত ইতোমধ্যে আমাদের কাছে আছে। তাদেরকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।'
তদন্তকারীরা জানান, এবার তারা অস্ত্র চোরাকারবারির সঙ্গে ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন।
এই তদন্তের সঙ্গে জড়িত সিটিটিসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি পাংখোয়া, খাসিয়া ও কুকি সম্প্রদায়ের কিছু সদস্য এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত আছেন। তাদের বেশিরভাগেরই ভারতীয় ও বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র আছে এবং তারা খুব সহজেই ২ দেশের মধ্যে যাতায়াত করতে পারেন।'
'অস্ত্রের চালানের আকারের অনুযায়ী একজন বাহক ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পেয়ে থাকেন,' বলে যোগ করেন তিনি।
অস্ত্র লাইসেন্সের কেনাবেচা
অপরাধীদের কাছে বৈধ অস্ত্র অবৈধভাবে বিক্রির কৌশল হিসেবে অনুমোদিত ব্যবসায়ীরা আগে বৈধ অস্ত্রের পুরনো অথবা তামাদি হয়ে যাওয়া লাইসেন্স কিনতেন।
উদাহরণস্বরূপ, ব্যবসায়ীরা এমন সব অস্ত্রের লাইসেন্স কিনতেন, যেগুলোর মালিক মারা গেছেন, মালিকের পরিবার অস্ত্রটি ফিরিয়ে দিতে চাইছে অথবা অস্ত্রের মালিক পাকাপাকি ভাবে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন।
আর্মস এনফোর্সমেন্ট দলের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'এই লাইসেন্সগুলো কেনার পর অস্ত্র ব্যবসায়ী অবৈধ অস্ত্রের ব্যারেলে এরকম একটি লাইসেন্স নম্বর খোদাই করে দিতেন। এভাবে খুব সহজে তারা নিরাপত্তা তল্লাশি এড়িয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ডেলিভারি দেওয়ার জন্য অবৈধ অস্ত্র বহন করতে পারতেন।'
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরবরাহ
কর্মকর্তাদের মতে, অপরাধীদের কাছে পাচার করা অস্ত্র সরবরাহ করার পাশাপাশি, সিন্ডিকেট একই সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেও লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা দাবি করেন, তারা গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে, একাধিক অপরাধী দল অবৈধ অস্ত্র ও বুলেট কিনছে। এই দলগুলো চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং স্থানীয় প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করার কাজে এই অস্ত্র ব্যবহার করছে।
এডিসি আহমেদুল বলেন, 'রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কিছু বাসিন্দার নাম আমাদের কাছে আছে। আমরা আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।'
তিনি জানান, সিন্ডিকেটের ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে এবং তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments