‘আমার সন্তান কোথায়… পুলিশ দিয়ে হয়রানি করবেন না’

পুলিশ, র্যাবসহ সরকারের বিভিন্ন অফিসে ঘুরে দেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়াদের সন্ধান পাচ্ছেন না স্বজনরা। গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের অভিযোগ, তাদের আপনজনরা গুম হয়েছেন সে কথাটিও তাদেরকে বলতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি তাদের কেউ গুম হয়নি এই মর্মে সাদা কাগজে সই নেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ স্বজনদের।
আজ শনিবার প্রেসক্লাবে মায়ের ডাক আয়োজিত অনুষ্ঠানে এমনটাই অভিযোগ করেন গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা। তারা বলেছেন পুলিশ তাদের নানাভাবে হয়রানি করছেন। এই হয়রানির দাবি জানিয়েছেন তারা।
তিতুমীর কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল কাদের মাসুমের মা আয়েশা আলী বলেন, 'মাসুম খুব মেধাবী ছিল। তার ইচ্ছে ছিল সে সরকারি প্রশাসনে চাকরি করবে। মাসুমকে হারিয়ে আমরা অসহায়, অক্ষম, স্তবদ্ধ হয়ে গেছি। মাসুমের বাবা মাসের পর মাস অসুস্থ থাকে। মাসুম আমার একটাই সন্তান তাকে হারিয়ে মাসের পর মাস মাস কষ্ট দুঃখ আর হয়রানির মধ্যে আছি। এটাই কি আমাদের জীবন?

'আমার একটাই সন্তান, একটাই সম্পদ ছিল। তাকে হারিয়ে আজ আমরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দুঃখ আর হয়রানির মধ্যে আছি।'
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার আই ব্লক থেকে র্যাব তাকে ধরে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন মাসুমের মা। তার পর থেকে তিনি আর ফেরেননি।
মাসুমের মা বলেন, 'যারা আমার সন্তানকে গুম করেছেন তারা তো শুনেন না, বুঝেন না, দেখেন না। আমরা কোথায় যাবো। আমাদের একটু ভরসা দিন।'
তিনি বলেন, 'পুলিশ ৫-১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ বার বাসায় এসেছে। তারা একেকবার একেক ধরনের কথা বলছে। বিভিন্ন ডকুমন্টে চাচ্ছে। আমাদের কেন এভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। আমার সন্তান কোথায় আছে, কেমন আছে একটু হদিস দেন। আমরা কষ্ট ব্যথা আর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। আমরা কার কাছে যাবো, কাকে বলবো। আমাদের কী অপরাধ। পুলিশ দিয়ে আমাদের আর হয়রানি করবেন না। আমাদের সন্তানের যদি হদিস দিতে পারেন তাহলে আমাদের ডাকেন আমরা যাবো।'

২০১৯ সালের ১৯ জুন কাঠ ব্যবসায়ি ইসমাইল হোসেন বাতেনকে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে র্যাব-৪ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন থেকে তিনি নিখোঁজ আছেন।
ইসমাইল হোসেন বাতেনের স্ত্রী নাসিমা আক্তার স্মৃতি বলেন, 'আমার স্বামী সেদিন যখন বাসা থেকে বের হয়ে যায় তখন আমার সন্তানদের বলে যায় যে আম নিয়ে আসবে। সন্তানরা আজও আমাকে বলে বাবা আম নিয়ে আসে না কেন। আমার বাচ্চারা জিজ্ঞেস করে, সবার তো বাবা আছে আমাদের বাবা নেই কেন। আমি উত্তর দিতে পারি না।'
রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে গুম হওয়া পারভেজের স্ত্রী ফারজানা বলেন, 'আমার স্বামী যখন গুম হয় তখন আমি ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার ছেলে এখন বাবা বলে ডাকতে পারে। ছেলেটার আমার হার্টের সমস্যা। আমি থানায় জিডি করতে গেছিলাম। কিন্তু জিডি নেয়নি। এখন আবার আমাদের কাছে জিডির কপি চায় পুলিশ। কেন আমাদের থানায় যেতে বলে।'
তিনি বলেন, 'আমার মেয়ে ৪ বছর ধরে মায়ের ডাকের এই অনুষ্ঠানে আসে। আমার মেয়ে হাসে না। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না। সব সময় নীরব থাকে। আমার মেয়ে প্রতি শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। আজ ১৫ তারিখ এখনো মেয়েকে ভালো কোনো স্কুলে ভর্তি করাতে পারিনি। তার বাবা থাকলে আমাদের তো কোনো সমস্যা থাকতো না।'
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, 'গুমের মধ্য দিয়ে একটা অপরাধ করা হয়েছে এখন সেই অপরাধ ঢাকানোর জন্য আরেকটা অপরাধ করা হচ্ছে। গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে সাক্ষর নেওয়া হচ্ছে। একজন ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে তা জানতে হবে। কিন্তু, আমাদের পুলিশের সেই জ্ঞান নেই।'
তিনি বলেন, 'যারা গুমের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার করতে হবে। গুম হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে।'
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, 'পুলিশ এখন বিপদে পড়েছে বলেই গুম হওয়াদের বাড়িতে যাচ্ছে তাদের রক্ষাকবচের জন্য। আন্তর্জাতিকভাবে চাপে থাকার কারণে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাক্ষর নিচ্ছে। তাদেরকে রক্ষাকবচ তৈরি করতে দেবেন না।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, 'কতটা অমানবিক হলে নিজের দেশের মানুষকে গুম করা যায়। আবার তাদের পরিবারের সদস্যদের নতুন করে হয়রানি করা হচ্ছে। যারা নিজেরা গুম করে তারা এর বিচার করে না। আজ সাদা কাগজে সই করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। আমরা এর ধিক্কার জানাই।'
তিনি আরও বলেন, 'যারা হুমকি দিচ্ছেন, সাদা কাগজে সই নিচ্ছেন, হয়রানি করছেন তাদের তথ্য রাখতে হবে। অবশ্যই তাদের একদিন বিচার হবে।'
Comments