ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ১০ বছর
'আমরা গুমের শিকার হওয়া পরিবারের সদস্যরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। আমরা চাই পরিবারের স্বার্থে আমাদের প্রিয়জনকে দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়া হোক এবং এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের পেছনে থাকা অপরাধীদের চিহ্নিত করা হোক।'
কথাগুলো বলছিলেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদির লুনা।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপির তখনকার সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস ও তার গাড়িচালক আনসার। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে ২ পরিবারের নিরন্তর অপেক্ষা।
আদালত কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে তারা এ বিষয়ে কোনো প্রতিকার পাবেন কি না তা খুবই অনিশ্চিত। যেহেতু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হলফনামা দিয়ে হাইকোর্টকে জানিয়েছে যে, নিখোঁজ ২ জনকে তারা তুলে নেয়নি বা আটক করেনি।
গত শুক্রবার দ্য ডেইলি স্টার'র সঙ্গে আলাপকালে তাহসিনা বলেন, 'আমি ও আমার পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণও এটা বিশ্বাস করে যে, সরকার আমার স্বামী ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে। এটাও সবাই জানে যে আমার স্বামীসহ অন্য বিএনপি নেতাদের বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই গুম করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার কর্তৃপক্ষকে ভুক্তভোগীদের ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছে। আমরাও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু ন্যায় বিচার নিশ্চিত না করে তারা এ জন্য ভিকটিমদেরই দোষারোপ করেছে।'
তাহসিনা জানান, এখন তার পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার স্বামীকে অবৈধভাবে আটকে রেখেছে দাবি করে ইলিয়াসের স্ত্রী ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন।
তিনি তার স্বামীকে হাজির করার জন্য হাইকোর্টের আদেশ চেয়েছিলেন।
এর জবাবে কেন ইলিয়াসকে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হবে না অথবা তাকে আটক করা হয়নি এই মর্মে প্রমাণ দিতে হাইকোর্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ১০ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা হাজির করার জন্য একটি রুল দেন।
হাইকোর্ট এখনো এই রুলের ওপর শুনানি শুরু করতে পারেননি। কারণ আবেদনকারী বা রাষ্ট্রপক্ষ- কেউই এ বিষয়ে আর কোনো উদ্যোগ নেননি। তাই বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, তবে ৫টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করে দাবি করে যে, ইলিয়াস তাদের হেফাজতে ছিল না। যেহেতু তারা তাকে তুলে নেয়নি বা আটক করেনি।
২০১২ সালের মে মাসে, ১৯ এপ্রিল দেওয়া রুলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৫টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হাইকোর্টে প্রতিবেদনগুলো জমা দেয়।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও বনানী থানা কার্যালয় থেকে তৈরি করা এসব প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ইলিয়াসের খোঁজ পাওয়ার জন্য তারা প্রয়োজনীয় সব প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
ইলিয়াসের মামলার পর গুমের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে আরও কয়েকজন হাইকোর্টে যান। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা প্রতিকারে আদালত এখনো কোনো আদেশ দেননি।
ইলিয়াসের স্ত্রীর পক্ষে আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন এই প্রতিবেদককে জানান, কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না বিধায় হাইকোর্টের রুল নিয়ে শুনানির কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। কারণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদালতকে বলেছে যে, তারা ইলিয়াস আলীকে আটক করেনি।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য শুক্রবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ইলিয়াস আলী সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না।'
একইভাবে এ ব্যাপারে কিছু জানেন না জানিয়ে ইলিয়াসের স্ত্রীর করা রিট আবেদনের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ শাহদীন মালিকের বক্তব্য, 'গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যদি সরকার এভাবে অস্বীকার করে তাহলে পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উন্নয়ন হবে না।'
নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর গত কয়েক মাসে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা কমেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শাহদীন মালিক আরও বলেন, ভুক্তভোগীদের পরিবার আদালত থেকে কোনো প্রতিকার পাবে কি না তা অনিশ্চিত। কারণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলেছে যে তারা ভিকটিমদের আটক করেনি বা তুলে নেয়নি।
Comments