একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড

রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে হত্যার কারণ এবং এই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত বন্দুকধারীদের পরিচয় এখনো উদঘাটন করা যায়নি। এ অবস্থায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরতদের মনে ভর করেছে ভয়, হতাশা ও ক্ষোভ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নেতৃস্থানীয় এই প্রতিনিধিকে তার পরিচিত লোকজনই হত্যা করে থাকতে পারে। কারণ, গত বুধবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে কুতুপালং ক্যাম্পে মুহিব উল্লাহর কার্যালয়ে প্রবেশ করার সময় কেউ হত্যাকারীদের বাধা দেয়নি।

তবে মুহিব উল্লাহর ভাই হাবিব উল্লাহর দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ) হাত আছে। তিনি এ ঘটনার তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।  

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের ৪৮ বছর বয়সী চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহকে গতকাল সন্ধ্যায় কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ক্যাম্পের ভেতর চারমুখ কবরস্থানে দাফন করা হয়।

মুহিবের জানাজায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা অংশ নেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও সুরক্ষার ব্যাপারে কথা বলতেন, এমন একজন নেতাকে হারিয়ে তারা সবাই ছিলেন হতবিহ্বল।

তদন্তকারীরা এই ঘটনাকে একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখছেন। প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন, জনপ্রিয়তা ও সবস্তরের রোহিঙ্গাদের কাছে প্রিয় মুখ হওয়ার কারণেই মুহিব উল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজারের আর্মড পুলিশ ব্যাট্যালিয়ন-১৪ এর কমান্ডিং অফিসার নাইমুল হক বলেন, 'আমরা সন্দেহ করছি, মুহিব উল্লাহর পরিচিত লোকেরা এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। কারণ আমরা ঘটনাস্থলে কোনো ধরনের হাতাহাতির চিহ্ন পাইনি।'

খুবই পরিকল্পিত উপায়ে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করা হয়েছে উল্লেখ করে আর্মড পুলিশ ব্যাট্যালিয়নের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'বহিরাগত হলে মুহিব উল্লাহর সমর্থকরা তাদের থামাত।'

কর্মকর্তারা জানান, পুলিশ এখন ঘটনাস্থলে পাওয়া গুলির খোসা পরীক্ষা করছে।

হত্যাকাণ্ডের পরপরই স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাম্পজুড়ে বিশেষ সতর্কতা জারি করলে ক্যাম্পের বাসিন্দারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ক্যাম্প এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

কমান্ডিং অফিসার নাইমুল হকের ধারণা, যারা রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বে থাকার চেষ্টা করছে তাদের এই হত্যাকাণ্ডে হাত থাকতে পারে। এ ছাড়া, মুহিবের নিজের সংগঠনের ভেতরের ফাটলও তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মুখোশধারী আততায়ীরা মুহিবের কার্যালয়ে ঢুকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি চালায়।

দ্য ডেইলি স্টারকে সূত্রটি আরও জানায়, 'কোন অপরাধী চক্রের কাছে এই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আছে এবং কারা এগুলো ব্যবহার করছে, তা রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনও জানে।'

মুহিব ছিলেন আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে স্বীকৃত কণ্ঠ। তিনি স্ত্রী, ৪ ছেলে ও ৫ মেয়ে রেখে গেছেন।

শিক্ষক থেকে মানবাধিকার কর্মী হওয়া মুহিব ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসেন। ওই দফায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংস দমন-পীড়নের শিকার হয়ে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা এ দেশে পালিয়ে আসে।

২০১৯ সালে মুহিবের নেতৃত্বে কুতুপালং ক্যাম্পে একটি বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এরপরই ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি।

পরে ওই বছর মুহিবকে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউজে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। হোয়াইট হাউজে তিনি ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে এক বৈঠকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেন।

'আমার ভাইকে হত্যা করেছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি'

মুহিবের ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ জানান, প্রায় ২০ জন লোক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মুহিবের কার্যালয়ে হাজির হয় এবং তাকে গুলি করে হত্যা করে।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'এআরএসএর সশস্ত্র জঙ্গিরা আমার ভাইকে মেরেছে। কারণ, তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।'

হাবিব আরও বলেন, 'আমার ভাই ক্যাম্পে সবসময় শান্তির পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি মাদকের অপব্যবহারসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।'

হাবিব এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৩ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করলেও ডেইলি স্টারের পক্ষে তা যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।

আশ্রয়শিবিরের প্রবীণ বাসিন্দা জালাল আহমেদ বলেন, 'আমরা একইসঙ্গে হতাশ ও দুঃখভারাক্রান্ত। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।'

৪ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, 'আমরা আমাদের অভিভাবককে হারিয়েছি। জানি না তার পর্যায়ের আর কোনো নেতা পাব কি না।'

মুহিবের মৃত্যুর পর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার নাইমুল হক বলেন, 'নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পে আর্মড পুলিশের প্রায় ৩০০ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।'

পুলিশ জানায়, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় মুহিব উল্লাহর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Yunus in Rome to attend Pope Francis’ funeral

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus reached Rome yesterday to attend the funeral of Pope Francis.

4h ago