অপরাধ ও বিচার

গুম: জোর করে সই নিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে

সম্প্রতি কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো আবারও আলোচনায় এসেছে। এ অবস্থায় পুলিশ গুমের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো আবারও আলোচনায় এসেছে। এ অবস্থায় পুলিশ গুমের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করতে শুরু করেছে।

কিছু পরিবারের অভিযোগ, হয়রানির পাশাপাশি তাদের জোর করে লিখিত বিবৃতিতে সই করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব মুচলেকায় বলা হয়েছে, 'স্বাক্ষরকারী ইচ্ছাপূর্বক তথ্য গোপন করে পুলিশকে ভুল পথে পরিচালিত করেছেন।'

তাদের দাবি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজেদের দায়মুক্ত করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নিয়েছে।

মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্য, গুমের ঘটনার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সংযুক্ত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও ভুক্তভোগীদের পরিবার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারেন না।

এর বিপরীতে পরিবারের সদস্যদের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে দেওয়া হয় অথবা মামলার বিবৃতিতে লেখা হয়, ভুক্তভোগী 'হারিয়ে গেছেন', 'কখনো ফেরেননি' অথবা 'অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে গেছেন'।

গত সোমবার সবুজবাগ থানার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রাজধানীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা মাহবুব হাসান সুজনের বাসায় আসেন। সুজনের ভাই জাহিদ খান গতকাল বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানান।

২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর সবুজবাগ থানার ছাত্রদল নেতা সুজনকে একদল সাদা পোশাক পরা সশস্ত্র ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে তুলে নিয়ে যায়।

জাহিদ বলেন, 'কর্মকর্তারা গত ১০ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে আসে। তারা একটি লিখিত বিবৃতি নিয়ে এসেছিলেন। সে বিবৃতিতে সই করার জন্য তারা আমার বাবাকে চাপ দিতে থাকেন। বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস হস্তক্ষেপ করায় তিনি বিবৃতিতে সই করেননি।'

দ্য ডেইলি স্টার ওই বিবৃতির একটি অনুলিপি সংগ্রহ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, 'আমার ছেলে মাহাবুব হাসান সুজন যে নিখোঁজ হইয়াছে সে ঘটনাটি আমি পুরোটা আড়াল করে ভুল তথ্য দিয়ে সবুজবাগ থানায় গত ইং ১১/১২/২০১৩ তাং উল্লিখিত সাধারণ ডায়রীটি এন্টি (এন্ট্রি) করি।'

'এটাই আমার জবানবন্দী'— এই বাক্যের ভেতর দিয়ে বিবৃতি শেষ হয়।

জাহিদ জানান, সুজনকে 'গুম' করার পর তার বাবা থানায় জিডি করতে গেলে সেখানে তাকে 'সশস্ত্র মানুষ সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়'— এই কথাটি লিখতে দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, 'আমরা শুধু লিখতে পেরেছি যে, তিনি হারিয়ে গেছেন। তাদের কথা মতো কাজ না করা পর্যন্ত তারা অভিযোগ গ্রহণ করছিলেন না।'

৮ বছরেরও বেশি সময় আগে সেদিন সুজনের সঙ্গে কাজি ফরহাদকেও তুলে নেওয়া হয়েছিল। ফরহাদ সবুজবাগ এলাকায় বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের সংগঠক ছিলেন।

সবুজবাগ পুলিশের একটি দল ফরহাদের বোন ও দুলাভাইর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাদেরও একই ধরণের একটি বিবৃতিতে সই করতে বলেন।

ফরহাদের দুলাভাই সাইদুর রহমান ডলার বলেন, 'আমার শালা অন্তর্ধান হওয়ার পর যে জিডি করেছি, সেখানে আমি "তথ্য গোপন" করেছি, এ কথা লেখার জন্য আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়।'

তিনি বলেন, 'আমাকে সেখানে স্বাক্ষর করতে হয়েছে, কারণ আমরা এলাকায় "প্রভাবশালী" না।'

সাইদুর রহমানের ভাষ্য, তাদেরকে জিডিতে প্রকৃত সত্য গোপন করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

গুমের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যদের প্ল্যাটফর্ম 'মায়ের ডাক' এর প্রধান সাঞ্জিদা তুলির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ ধরনের কমপক্ষে ১০টি পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছে পুলিশ।

তুলির ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমনকে ২০১৩ সালে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি এখনো ফেরেননি।

জাতিসংঘের গুম সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপের (ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস) তালিকায় বাংলাদেশের ৭৬টি অমীমাংসিত গুমের ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ডব্লিউজিইআইডি জানায়, তারা বারবার সরকারের কাছে এই ঘটনাগুলো সম্পর্কে তথ্য চেয়েও পায়নি।

পুলিশ এমনকি তুলির বাসাতেও গেছে।

তিনি বলেন, 'তেজগাঁও থানা থেকে একটি দল আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলার জবানবন্দিগুলো নিয়ে এসেছিল। এত বছর আমি এই মামলাগুলোর কথা শুনিনি। কারণ আমি তাকে খুঁজতে বাড়ি বাড়ি গিয়েছি।'

২০১৩ সালে নাখালপাড়া থেকে অন্তর্ধান হন আবদুল কাদের ভুঁইয়া মাসুম। মাসুমের মা আয়েশা আলি জানান, তার কাছে ৩ বার পুলিশ এসেছে। গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার, রোববার এবং সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার।

আয়েশা বলেন, 'আমি জিডিতে "সে হারিয়ে গেছে" লিখতে বাধ্য হই।'

তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। সবুজবাগ থানার ওসির সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

২০১৫ সালে আরেক ভুক্তভোগী নূর আলমকে গাজীপুর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ তার স্ত্রী রীনা আলমের সঙ্গে দেখা করেছে।

রীনা জানান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পোশাক পরিহিত অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, 'ইউনিফর্ম পরা মানুষ তাকে তুলে নিয়েছে, কিন্তু আমাকে এই কথা জিডিতে লিখতে দেওয়া হয়নি।'

ইতোমধ্যে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ ধরনের কার্যক্রমের নিন্দা জানিয়েছে।

সংস্থাটি গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছে, 'পুলিশ ভুক্তভোগীদের পুরিবারের কাছ থেকে বক্তব্য সংগ্রহ করছে। যেখানে বলা হচ্ছে ভুক্তভোগীরা কোথাও লুকিয়ে আছেন। এটি বেআইনি এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।'

গত ১০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাব ও তার ৭ জন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর থেকে এই ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে। একইসঙ্গে দেশটির বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশকে ডিসেম্বরের ৯ ও ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলনেও যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়নি।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

13 killed in bus-pickup collision in Faridpur

At least 13 people were killed and several others were injured in a head-on collision between a bus and a pick-up at Kanaipur area in Faridpur's Sadar upazila this morning

1h ago