ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চড়া মূল্য দিচ্ছে এক কিশোরী

ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে পবিত্র কোরআন অবমাননা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার কথিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ বছর ধরে কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে ধুঁকে মরছে ১৭ বছরের এক কিশোরী।
ঠিক ১ বছর আগে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী দীপ্তি রানী দাসকে ট্রেন থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে থানায় সোপর্দ করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়।
মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) অনুসারে 'ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপরাধে' দীপ্তিকে গ্রেপ্তার করে পার্বতীপুর পুলিশ।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে দিপ্তীর জামিন আবেদন ৪ বার নামঞ্জুর করা হয়েছে। শেষবার তার জামিন বাতিল করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
চলতি বছরের ১১ মে উচ্চ আদালত দীপ্তিকে ৬ মাসের জামিন দিলে তিনি প্রায় বেরিয়েই এসেছিলেন। এর আগে দিনাজপুরের আদালত ৩ বার তার জামিন নাকচ করেন।
উচ্চ আদালত থেকে জামিন মঞ্জুর হওয়ার ৮ দিনের মাথায় দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক দীপ্তির জামিনের আদেশ স্থগিত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়, 'মুলতবি আপিলে হাইকোর্ট ডিভিশনের দেওয়া জামিনের অন্তর্বর্তী আদেশে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, তা বিচারিক আবেদন উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এফআইআর-এ বিবাদীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক ও সুনির্দিষ্টভাবে যে জঘন্য কাজের অভিযোগ আনা হয়েছে তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮ ও ৩১ ধারা অনুসারে অপরাধ।'
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন যা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান কিংবা হেয় প্রতিপন্ন করে, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। পাশাপাশি ধারা ২৮ ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করা এবং ধারা ৩১ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো সংক্রান্ত।
এই সবগুলো ধারাই জামিন অযোগ্য—এমন একটি শর্ত, যা আপাতদৃষ্টিতে ১৭ বছরের কিশোরীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আপিল বিভাগে করা আবেদনে আরও বলা হয়, 'মামলাটি এখন তদন্তাধীন। এই অবস্থায় জামিনের অন্তর্বর্তী আদেশ প্রসিকিউশনের মামলার উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণভাবে হতাশ করবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ তদন্তের পথে বাধা তৈরি করবে।'
সুতরাং, এখনো দীপ্তি রাজশাহীর একটি সংশোধন কেন্দ্রে পড়ে আছে।
দীপ্তির বাবা দিলীপ দাস বলেন, 'মেয়েকে দেখতে যেতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগে। ২ মাস আগে শেষবার আমি তাকে দেখেছি।'
যে 'জঘন্য অপরাধ' এর জন্য দীপ্তিকে জেলে রাখা হয়েছে, তা হলো একজন নারীর উরুর ওপর রাখা পবিত্র কোরআনের একটি ছবি শেয়ার করা। মামলার এফআইআরে আরও উল্লেখ করা হয়, ছবিটি 'ধার্মিক মুসলিমদের হৃদয়' আক্রান্ত করেছে।
দীপ্তির বাবা জানান, তার মেয়ে তাকে বার বার বলছিল যে, তার প্রোফাইল হ্যাক করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'যখন আমার মেয়ের প্রোফাইল থেকে ছবিটি শেয়ার করা হয়, তখন সেটা স্থানীয়দের চোখে পড়ে। তারা এ ব্যাপারে আমাদের বাড়িতে অভিযোগ জানাতে আসেন। তখন আমি আমার মেয়েকে তিরস্কার করি এবং তার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাই।'
ব্যবসায়ী দিলীপ দাস একটি হার্ডওয়্যারের দোকান চালান। তিনি আরও বলেন, 'এমনকি তারা (স্থানীয়রা) তারা আমার দোকানেও হামলা করতে গিয়েছিল। কিন্তু অন্য ব্যবসায়ীরা বাধা দেন। বলেন যে, আমি একজন ভালো মানুষ এবং আমি মুসলিম সম্প্রদায়কে আঘাত কিংবা অসম্মান করার মতো কিছু করিনি।'
দিলীপ বলতে থাকেন, তার জন্ম পার্বতীপুরে। আর তিনি তার গোটা জীবন ওই এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রীতির ভেতর দিয়ে কাটিয়েছেন।
'আমি বুঝতে পারছিলাম যে, কোনো না কোনোভাবে আমার মেয়ের ক্ষতি হতে পারে। তাই খালার কাছে পাঠানোর জন্য আমি তাকে সন্ধ্যার ট্রেনে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু যুবক সেটা লক্ষ করে। এমনকি ট্রেন চলতে শুরু করলেও তারা সেটা থামিয়ে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নামায়। পরে থানায় সোপর্দ করে।'
আর তখন থেকে শুরু হয় দীপ্তির অগ্নিপরীক্ষা।
স্থানীয় একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দীপ্তি কেবল দশম শ্রেণির পড়া শেষ করেছিল। এমনকি একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিও হয়েছিল সে। কিন্তু সংশোধন কেন্দ্রে যাওয়ার পর থেকে তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে।
দীপ্তির অসহায় বাবা বলেন, 'বন্দিশালায় পড়ালেখার কোনো সুযোগ নেই। ওখানকার খাবার খুব নিন্মমানের হওয়ায় তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। আমরা মাঝে মাঝে টাকা পাঠাই, যাতে সে খাবার কিনে খেতে পারে।'
দীপ্তির আইনজীবী শাহিনুজ্জামান জানান, জামিন দেওয়ার সময় দীপ্তিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। জামিন আদেশ স্থগিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে জামিন দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে হাইকোর্টে শুনানি হওয়ার কথা আছে। তারা এখন ওই শুনানির তারিখের জন্য অপেক্ষা করছেন।
মেয়ের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন দীপ্তির মা অনিমা। তিনি বলেন, 'সে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতো। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছিল। এখন যদি সে জামিনে বের হয়েও আসে, তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। কারণ সে আর এই সমাজে টিকতে পারবে না।'
অনিমা আরও জানান, মুসলিম ক্রেতারা এখনই তার স্বামীর দোকান এড়িয়ে চলছেন। তাতে করে তাদের ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments