ডিবি পরিচয়ে ডলার প্রতারণার অভিযোগে সেনা সদস্যসহ গ্রেপ্তার ৬

অনলাইনে কম দামে ডলার বিক্রির কথা বলে ফ্রিল্যান্সার ও ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে ফাঁদ পাততো চক্রটি। পরে টাকা হাতিয়ে নিয়ে 'ডিবি পুলিশ' পরিচয় দিয়ে তুলে নেওয়া হতো এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। সন্দেহ এড়াতে চক্রটি সঙ্গে রাখতো ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ ও একটি নীল গাড়ি।
নগরীর ২ থানায় পরপর এমন ২টি ঘটনায় মামলা হওয়ার পর গত ২৬ মার্চ ওই প্রতারণা চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) হালিশহর থানা পুলিশ।
ওই চক্রে এক সেনা সদস্য ও চাকরিচ্যুত এক নৌবাহিনীর সদস্যও রয়েছেন। হালিশহর থানার মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—মো. পলাশ হোসেন (৩০), মো. বায়েজিদ ইকরাম (২৭), মো. আশরাফুল আলম (৩৩), মো. বুলবুল আহমেদ (৩২) এবং আলমগীর হোসেন (৩২)। এ ছাড়াও চক্রের আরেক সদস্য মো. শাহারুল ইসলাম (৩৪) পলাতক রয়েছেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আলমগীর হোসেন সেনাবাহিনীর ল্যান্স করপোরাল এবং ইকরাম নৌবাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ। আদালত থেকে প্রাপ্ত নথি থেকে জানা যায়, সেনা সদস্য আলমগীর একটি গোয়েন্দা শাখার চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত।
তাদের কাছ থেকে পরিচয়পত্র, একটি ওয়াকিটকি এবং নীল রংয়ের একটি ডাবল কেবিন পিকআপ ভ্যান জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) আবদুল ওয়ারীশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনলাইনে স্বল্পমূল্যে ডলার বিক্রির প্রলোভন দিয়ে কৌশলে নগদ টাকা আত্মসাৎ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে ভয়ভীতি দেখাতো চক্রটি। আমরা মামলাটি তদন্ত করছি। এর সঙ্গে আর কারা জড়িত সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।'
'ইতোমধ্যে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে,' বলেন তিনি।
পুলিশ বলছে, এই চক্রটি কিছুদিন ধরেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে প্রতারণা করে মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল। গত ১৬ মার্চ নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন জিইসি এলাকায় 'বীকন আইটি' নামের একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে একই কায়দায় ইকবাল হোসেন নামে এক ফ্রিল্যান্সারের কাছ থেকে নগদ ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। ইকবালকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। তবে, ইকবাল তার এক পুলিশ আত্মীয়কে ফোন করলে চক্রটি তাকে রেখে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন ইকবাল।
মামলার বাদী ফ্রিল্যান্সার ইকবাল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি অনলাইনে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের (এসইও) কাজ করি, ফেসবুকে বুস্টিংয়ের কাজও করি। পাইওনিয়র নামের একটি আন্তর্জাতিক অ্যাপ দিয়ে আমি ডলার কিনি এবং ব্যবহার করি। কিছুদিন আগে একটি গ্রুপে কম দামে ডলার কেউ বিক্রি করবে কিনা জানতে চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেই।'
'পোস্ট দেওয়ার পর তানভীর আহম্মেদ নামে একটি আইডি থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় এবং তিনি ডলার বিক্রি করবেন বলে জানান। আমি তখন তাকে আমার অফিসের ঠিকানা দিয়ে আসতে বলি। ১৬ তারিখ সন্ধ্যায় একজন আমার অফিসে আসেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তাকে নগদ ৬০ হাজার টাকা দেই। টাকা নেওয়া মাত্রই বাইরে থেকে আরও ৪ জন আমার রুমে প্রবেশ করেন এবং ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে অবৈধভাবে ডলার কেনা-বেচার অভিযোগে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের কাছে ওয়াকিটকি ও হ্যান্ডকাফ ছিল,' বলেন তিনি।
ইকবাল আরও বলেন, 'তারা আমাকে একটি নীল রঙের গাড়িতে তোলার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে আমার এক পুলিশ আত্মীয়কে ফোন দেই। তখন তারা আমাকে ছেড়ে দিয়ে টাকা নিয়ে চলে যান। পরে প্রতারণার বিষয়টি ধরতে পেরে আমি ১৮ তারিখ থানায় মামলা করি।'
গত ২৬ মার্চ একই অভিযোগে হালিশহর থানায় মামলা করেন ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম।
মামলার বিবরণে তিনি জানান, কমদামে অনলাইনে ডলার বিক্রি হচ্ছে দেখে যোগাযোগ করলে গত ২২ মার্চ বিকেলে শাহারুল নামে একজন তাকে হালিশহর বড়পোল মোড়ে আসতে বলেন। তাকে আশ্বস্ত করা হলে তিনি ৮ হাজার মার্কিন ডলারের বিপরীতে নগদ ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাকি ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। যখন ডলার ট্রান্সফারের কথা বলা হয়, তখন ২ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি 'ডিবি পুলিশ' পরিচয়ে তার কলার ধরে ফেলে। সেসময় আলমগীর তার হাতে থাকা ওয়াকিটকি দেখিয়ে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। পরে ভয়ভীতি দেখিয়ে হালিশহর থানাধীন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সামনে নামিয়ে দেন।
মামলার বিবরণে তিনি আরও জানান, এ ঘটনার পর হালিশহর থানাকে মৌখিকভাবে জানান তিনি। পরবর্তীতে একইভাবে আরেক বন্ধুকে দিয়ে মোবাইলে ডলার কেনার কথা বলে ফাঁদ পাতেন শরিফুল। সেদিন ওই চক্রের ৫ জন একই কায়দায় অর্থ হাতিয়ে নিতে গেলে পুলিশের সহায়তায় রাতেই ওই ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শরিফুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নিরাপত্তার প্রসঙ্গ টেনে তিনি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ মার্চ চট্টগ্রাম অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ইকবালের দায়ের করা মামলায় এই চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আদালত ১৬ মার্চের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাদের ওই মামলায় গ্রেপ্তারের আদেশ দেন বলে জানিয়েছেন ইকবালের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন শিকদার।
নথি থেকে জানা যায়, গত ২৬ মার্চ সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার মো. জিয়াউর রহমান আসামি আলমগীর ও তার ব্যবহৃত ওয়াকিটকি এবং পিকআপ ভ্যানটি আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে হেফাজতে নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হালিশহর থানার এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই চক্রটি "ডিবি পুলিশ" পরিচয়ে আরও কিছু অপরাধ করেছে। হয়তো আইনি ঝামেলার ভয়ে অনেকেই পুলিশের শরণাপন্ন হননি। আমরা মামলাটির অন্যতম আসামি শাহারুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছি। তাকে পেলে আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।'
নগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) আবদুল ওয়ারীশ বলেন, 'কয়েকজন ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কাজের সুবিধার্থে তারা পাইওনিয়র এবং পেপল দিয়ে ডলারে লেনদেন করেন। অনেকেই অনলাইনে ডলার কিনে এখন নানান কাজ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে বেআইনি কাজের মাধ্যমে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। এই সু্যোগটিকেই চক্রটি কাজে লাগাচ্ছিলো।'
Comments