দৌরাত্ম্য বেড়েছে বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের

চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের সদস্যরা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলে নির্বিচারে বন্য হাতি শিকার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুটি ভিন্ন ঘটনায় পাঁচ জনকে গ্রেপ্তারের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অভিযোগের বিষয়টি জানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছে থেকে তিনটি হাতির দাঁত উদ্ধার করা হয়েছে।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চোরাকারবারিরা গভীর জঙ্গল থেকে হাতি শিকার করে। এরপর বাঁশখালী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেগুলোর দাঁত পাচার করে।

উদ্ধারকৃত হাতির দাঁতগুলো দেখে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বিশেষজ্ঞ ও তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, হাতি না মেরে এসব দাঁত ও চোয়াল সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।

তারা আরও জানান, পাচারকারিরা সম্ভবত হাতির পালের চলার পথে বৈদ্যুতিক বেড়া বসিয়ে অথবা গুলি করে সেগুলো হত্যা করেছে।

তারা জানান, হাতির সঙ্গে মানুষের যে দ্বন্দ্ব, সেটিকে পুঁজি করেই চোরাকারবারিরা হাতিগুলো হত্যা করে। এরপর তাদের দাঁত কেটে সেগুলো পাচার করে।

বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রাম সার্কেলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সরাসরি গুলি করাসহ বিভিন্ন কারণে ১২০টি হাতির মৃত্যু হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জঙ্গলে অন্তত ১২টি হাতিকে পাচারকারিরা গুলি করে মেরেছে।

গত ৭ আগস্ট র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব-৭) সদস্যরা বন্দর নগরীর মোহোরা এলাকা থেকে হাতির দাঁতসহ তিন জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে দুই জন খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি ও আরেক জন রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির বাসিন্দা।

এ ছাড়া, গত ২৫ মে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্যরা অভিযান চালিয়ে কর্ণফুলী এলাকা থেকে হাতির দাঁতসহ দুই ব্যক্তিকে আটক করে। তারা দুই জনই বাঁশখালী উপজেলার পুঁইছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা।

র‍্যাবের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযুক্ত তিন জনকে জেরা করা হলে তারা পার্বত্য অঞ্চল থেকে হাতির দাঁত সংগ্রহ করার কথা জানায়। র‍্যাব আরও জানিয়েছে, তারা প্রতিবেশী দেশে সেগুলো পাচারের চেষ্টা করছিল।

কর্ণফুলীর ঘটনা তদন্ত নেমে ডিবি সদস্যরা আরও জানতে পারে, বাঁশখালী এলাকা থেকে হাতির দাঁতগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে, বন্যপ্রাণীরা যেখানে অবাধে ঘোরাফেরা করে।

গত কয়েক বছরে বাঁশখালী উপজেলায় বেশ কয়েকবার বন্য হাতির আক্রমণ ও মানুষের পাল্টা ধাওয়ার খবর পাওয়া গেছে এবং হাতির আক্রমণে বেশ কয়েক জন মারাও গেছেন।

এ ছাড়া, বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, হাতির পাল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে আসলে অনেক সময় স্থানীয়রা তাদের আক্রমণ করে।

সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি, ডিবি) নোবেল চাকমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অভিযুক্ত দুই জনকে রিমান্ডে নিলে তারা পুলিশকে জানিয়েছে, ৩৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অন্য একটি পক্ষের কাছে তাদের দাঁতগুলো হস্তান্তরের কথা ছিল।'

'তারা তদন্তকারীদের আরও জানিয়েছে, ২৪ ইঞ্চি লম্বা দাঁতগুলো বাঁশখালীর পাহাড়ি এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। সেখানকার স্থানীয়দের কাছ থেকে সেগুলো সংগ্রহ করেছে বলেও জানায়।'

এডিসি জানান, ঘটনা তদন্তের জন্য বাঁশখালীতে একটি টিম পাঠিয়েছিলেন। 'তবে, তদন্তকারী কর্মকর্তা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যার কারণে কিছুদিনের জন্য কাজটা থেমে আছে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি এবং কালোবাজারের নেটওয়ার্ক, পাচার হওয়া সামগ্রীর গন্তব্য ও এর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।'

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) মতে, বাঁশখালী-রাঙ্গুনিয়া, বন্দর ও রাঙ্গামাটি ও লোহাগড়া-সাতকানিয়ার চুনতিতে বন্য হাতি দেখা যায়। সেখানে হাতিদের বেশ কয়েকটি করিডোরও রয়েছে।

এ ছাড়া, কক্সবাজার-টেকনাফ জঙ্গলেও বেশ কয়েকটি করিডোর দেখা গেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপনের কারণে যেগুলো বাধাগ্রস্ত হয়। যে অঞ্চল দিয়ে হাতির পাল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়মিত যাওয়া-আসা করে, তাকে করিডোর বলে।

২০১৬ সালে আইইউসিএন পরিচালিত হাতি শুমারি থেকে দেখা যায়, কক্সবাজারের দক্ষিণাঞ্চলের বনে ৬৩টি হাতি এবং বান্দরবান, শেরপুর ও ময়মনসিংহসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ২০৫টি হাতি দেখা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা দেখেছি চোরা শিকারিরা রোহিঙ্গাসহ স্থানীয়দের হাতি আটকানোর জন্যে উসকানি দেয় এবং পরে সেগুলো শিকার করে।'

তিনি আরও বলেন, 'তারা কোন কৌশলে হাতি শিকার করে, সেটা নিশ্চিত না। তবে, বাঁশখালীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো প্রক্রিয়াটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।'

গত বছর চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন অফিসের (দক্ষিণ) আওতাধীন বাঁশখালীর কালিপুর রেঞ্জে দুই মাসের ব্যবধানে তিনটি এশিয়ান হাতি মারা গিয়েছিল।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তদন্তকারীরা বলেছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে ওই অঞ্চলের চোরা শিকারিরা সক্রিয়ভাবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রকৃতিবিদ ও জীববিজ্ঞানী মনিরুল এইচ খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা প্রতি বছর যে হারে হাতি মৃত্যুর ঘটনা দেখি, তা সত্যিই উদ্বেগজনক।'

বিশেষজ্ঞরা হাতি শিকারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, আবাসস্থল রক্ষা, মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত কমাতে উদ্যোগ নেওয়া ও হাতি সংরক্ষণে যথাযথ গবেষণা করারও সুপারিশ করেছেন।

আইন অনুসারে, হাতি হত্যা একটি জামিন অযোগ্য অপরাধ এবং অপরাধীদের ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। এ ছাড়া, এই অপরাধের জন্যে সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

চট্টগ্রামের সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) আবু নাসের মো. নেয়াজ ইয়াসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যতদূর মনে পড়ে, এর আগে হাতির দাঁত জব্দ করার কোনো রেকর্ড নেই। বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল এবং ব্যাপকভাবে তদন্ত করতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'বিপন্নপ্রায় এশিয়ান হাতি রক্ষার জন্যে এখন বন বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।'

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মুনীর মমতাজ

Comments

The Daily Star  | English

Polls could be held in mid-February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus has said the next general election could be held in the week before the start of Ramadan in 2026.

2h ago