নারায়ণগঞ্জে খুন: এক চিতায় মা-মেয়ের সৎকার, অনাগত সন্তান সমাহিত

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় মহাশ্মশানে দূরে থেকে বসে স্ত্রী ও মেয়ের সৎকার দেখছেন রামপ্রসাদ চক্রবর্তী। পাশে বসে আছেন স্বজনরা। ছবি: সনদ সাহা

আর কিছুদিন পরই ঋতু চক্রবর্তীর (২২) কোল জুড়ে প্রথম সন্তান আসার কথা ছিল। তাই শ্বশুর বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন বাবা। আনন্দের সঙ্গে সবাই নতুন অতিথি আসার অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন। স্ত্রী রুমা চক্রবর্তী (৪৬) ও মেয়ে খুন হয়ে সেই ঘরে এখন সুনসান নীরবতা। মা-মেয়ের সৎকার হয়েছে এক চিতায়। শ্মশানেই সমাহিত করা হয়েছে অনাগত সন্তানকে।

আজ দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের ডালপট্টি এলাকায় 'মাতৃভবন' নামে ছয়তলা বাড়িটির ওপরের ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজায় তালা দেওয়া দেখা যায়। প্রতিবেশীদের একজন বললেন, 'ঘরে কেউ নেই। এই সময়টায় তাদের রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল। এখন শ্মশানে তদের চিতা জ্বলছে। সেখানেই ঋতুর বাবাকে পাবেন।'

নম্বর জোগাড় করে ঋতুর বাবা রামপ্রসাদ চক্রবর্তীকে পরিচয় দিয়ে ফোন করতেই বলেন, 'আমি থানায় আছি। কী আর জানবেন, আমার তো সব শেষ। আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে। কথা বলার কিছু নেই।' এটুকু বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

গত মঙ্গলবার বিকেলে বাড়িটির ছয় তলার ফ্ল্যাট থেকে মা ও মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একজনের মরদেহ মেঝেতে রক্তমাখা ও আরেকজনের দেহ মেঝেতে পাতা বিছানার অর্ধেক ওপরে ও অর্ধেক মেঝেতে ছিল। সেখান থেকে রক্তমাখা ধারালো ছুরি সহ জোবায়ের নামে এক যুবককে আটক করে পুলিশ।

নিহত ঋতু চক্রবর্তীর স্বামীর নাম শ্যামল চক্রবর্তী। চট্টগ্রামে শ্যামলের গাড়ির ব্যবসা আছে।

দুপুরে দুইজনের ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশের মাধ্যমে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে সেখান থেকে মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়।

দুইজনের পেটে ও পিঠে ছুরির আঘাত: আরএমও

নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. এস কে ফরহাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মা-মেয়ে দুজনকেই পেটে ও পিঠে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। সেই আঘাত লিভার ও কিডনিতে গিয়ে লেগেছে। এতে রক্তক্ষরণ হয়ে দুইজন মারা যান।'

তিনি বলেন, 'অন্তঃসত্ত্বার গর্ভের মৃত সন্তানটিকে বের করা হয়েছে। ওই শিশুসহ দুই জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।'

মা মেয়ে এক সাথে চিতায়, অনাগত শিশুকে দাফন

বিকেল সাড়ে ৪টায় শহরের মাসদাইর এলাকায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় শ্মশানে গিয়ে দেখা যায়, 'পাশাপাশি মা ও মেয়ের সৎকার করা হচ্ছে। আর দূরে আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে বসে দেখছেন রামপ্রসাদ। কিছুক্ষণ পর পর আহাজারি করছেন। নিজের কপাল চাপড়াচ্ছেন। স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছেন। শ্মশানের খোলা জায়গায় এক পাশে অনাগত শিশুর দাফন হয়েছে।

আমার সংসার শূন্য করে দিয়েছে: রামপ্রসাদ

রামপ্রসাদ চক্রবর্তী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাসার পাশেই একটি দোকানে চাকরি করি। আমার ছেলে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করে। ঘরে শুধু মা, মেয়ে ও ছেলের বউ ছিল। দুপুরে চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে আমাদের বাড়ির সামনে ভিড় দেখে সামনে যাই। গেটে তালা দেওয়া ছিল। পরে আমার স্ত্রীর মোবাইলে কল করি। প্রথমবার ফোন ধরেনি। পরে খুনিটা (জোবায়ের) ফোন ধরে বলে, স্বর্ণালংকার ও টাকাপয়সা কোথায় কী আছে বল, না হলে সবাইকে মেরে ফেলব।'

তিনি বলেন, 'আমার স্ত্রী ও মেয়েকে আগেই মেরে ফেলে জোবায়ের। পাশের রুমে গিয়ে ছেলের বউ শীলাকে বটি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। শীলা বটি ধরে ফেলে এবং ধাক্কা দিয়ে জোবায়েরকে ফেলে দিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে আসে। না হলে তাকেও মেরে ফেলত।'

তিনি বলেন, 'কী কারণে আমার স্ত্রী ও মেয়েকে হত্যা করা হলো আমি জানি না। আমি এসে দেখি সব শেষ। কারো সঙ্গে আমাদের শত্রুতা নেই।'

'তিন বছর আগে ঋতুর বিয়ে দেই। সে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই দাদু ভাইকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছি। যে পৃথিবীর আলো দেখেনি তার কি দোষ ছিল। একসঙ্গে তিনটি জীবন কেড়ে নিয়েছে। আমার সংসার শূন্য করে দিয়েছে,' বলে আবার আহাজারি শুরু করেন তিনি।

কিছুটা শান্ত হয়ে আবার বলেন, 'আমি প্রতিদিন ওইসময় দুপুরের খাবার খেতে বাসাই যাই। কিন্তু কাল কাজের চাপ থাকায় যাইনি। ওই খুনি গিয়ে (জোবায়ের) যখন কলিংবেল চেপেছে তারা ঘরের ভেতর থেকে ভেবেছে আমি গেছি, তাই দরজা খুলছে।'

দুইজনকে একা হত্যা করে জোবায়ের: ওসি

নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, জোবায়েরকে একমাত্র আসামি করে রামপ্রসাদ চক্রবর্তী হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। জোবায়েরকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বিকেল ৫টা পর্যন্ত কোন শুনানি হয়নি।

তিনি বলেন, 'প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জোবায়ের জানিয়েছে, টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করতে দুইজনকে হত্যা করে। সে ওই ভবনের ষষ্ঠ তলার আরেকটি ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজিয়েছিল। কিন্তু ওই ফ্ল্যাটের কেউ দরজা খোলেনি। তখন পাশের রামপ্রসাদের ফ্ল্যাটের বেল বাজায়। রুমা চক্রবর্তী দরজা খুললে প্রথমে তাকে ছুরি মেরে হত্যা করে। পরে ঋতু এগিয়ে এলে তাকেও ছুরি দিয়ে হত্যা করে জোবায়ের।'

তিনি আরও বলেন, 'পুরো ঘটনাটি সে একাই ঘটিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। তবে তার সাথে আরও কেউ ছিল কিনা কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল কিনা সেসব বিষয়ে জানতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছি। তখন ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিস্তারিত জানা যাবে।'

জোবায়ের একটু মানসিক ভারসাম্যহীন: এসপি

নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রাথমিকভাবে যা পেয়েছি তাতে, ছেলেটা একটু মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় আছে। তার মধ্যে হতাশা কাজ করছিল অনেক দিন ধরে। মূলত স্বর্ণালংকার ও টাকা নিতেই এ কাজ করছে।'

নিহত রুমা চক্রবর্তীর ছেলে মুসলিম নারীকে বিয়ে করা নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন,

'এ বিষয়ে জোবায়েকে জিজ্ঞাসা করা হয়। সে জানত না যাকে হত্যা করতে গিয়েছিল সেই নারী মুসলিম। তারপরও আমরা খুঁজে দেখছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Anatomy of BGB shootings in Rampura

It was 6:14pm on Friday, July 19, 2024. Two Border Guard Bangladesh (BGB) personnel were advancing into Banasree G Block in Dhaka.

12h ago