ব্লগার হত্যা: তারা এখনো ন্যায়বিচার পাননি

রাজিয়া রহমানকে ৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই দীর্ঘ অপেক্ষার পর তিনি তার স্বামী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় রায় পেয়েছেন।
ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যার খবর শুনে তার মা ও স্বজনদের আহাজারি। স্টার ফাইল ছবি

রাজিয়া রহমানকে ৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই দীর্ঘ অপেক্ষার পর তিনি তার স্বামী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় রায় পেয়েছেন।

কিন্তু বিচারিক আদালতে রায় ঘোষণার পর প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তিনি জানেন না কবে এই মামলার আইনি প্রক্রিয়া শেষ হবে এবং কবে চূড়ান্ত বিচার পাবেন।

মামলাটি এখন হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।

ভারাক্রান্ত কণ্ঠে রাজিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, 'আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে আইনি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার কোনো উপায় নেই। আমরা যা করতে পারি, তা হলো ন্যায়বিচারের দাবি জানানো।'

জাগৃতি প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী দীপনকে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর কুপিয়ে হত্যা করেন একটি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। ৪৩ বছর বয়সী দীপন তখন রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের ভেতরে প্রকাশনীর কার্যালয়ে ছিলেন।

বাংলাদেশি-মার্কিন লেখক অভিজিৎ রায়ের লেখা বই প্রকাশের কারণে তাকে হত্যা করা হয়। দীপন হত্যার আট মাস আগে অভিজিৎকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের ওপর হামলা শুরু হয়। অভিজিৎ ও দীপনের ওপর হামলাও এর অংশ ছিল বলে মনে করা হয়।

গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল দীপন হত্যা মামলার রায় দেন। রাজিয়া রহমানের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত ৮ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।

আপাতত আসামিদের পক্ষ থেকে দায়ের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

রাজিয়া বলেন, 'নিম্ন আদালতের রায়ের পর এখন উচ্চ আদালতে মামলাটি আটকে আছে। আদালতের পক্ষ থেকে যত দ্রুত এ ধরনের সব মামলার রায় দেওয়া হবে, সবার জন্য ব্যাপারটা ততটাই ভালো হবে। এরকম না হলে, মামলাগুলো চাপা পড়ে যাবে।'

বাংলাদেশে জঙ্গিবিরোধী ব্যাপক অভিযানের কারণে হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তবে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের কারও পরিবার এখনও চূড়ান্ত ন্যায়বিচার পাননি। রাজিয়ার মতো, বেশিরভাগ ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা এর জন্য ধীরগতির আইনি প্রক্রিয়াকে দায়ী করেন।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে ছোট একদল মুক্তমনা ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বন্ধের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা করেন। পরবর্তীতে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা ব্লগার ও মুক্তমনাদের ওপর হামলা শুরু করে।

'শাহবাগ আন্দোলন' খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্লগারদের ইসলামবিরোধী ও নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করে সুপরিকল্পিত প্রচারণা শুরু হয়।

এরপরই তাদের কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। পুলিশের তদন্ত মতে, হামলাগুলোর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল তাদের কণ্ঠ ও চিন্তাধারাকে রুদ্ধ করা।

২০১৫ সালে সারা দেশে অন্তত ১০ জন মুক্তমনা, ব্লগার ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। মাত্র ৭ মাসের ব্যবধানে ৪ জনকে হত্যা করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আল-কায়েদার আদর্শে অনুপ্রাণিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) বা আনসার আল ইসলাম এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।

মামলার বর্তমান অবস্থা

মামলাগুলোর মধ্যে, সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত ৬ জন ব্লগারের হত্যাকাণ্ডের মামলার রায় দিয়েছে এবং হাইকোর্ট ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের হত্যাকাণ্ডের মামলার রায় দিয়েছেন। ব্লগারদের মধ্যে রাজীব প্রথম জঙ্গিদের হাতে নিহত হন।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এখনো রাজীব হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের করা আপিলের শুনানি শুরু করেনি

বাকি ৩ হত্যা মামলার বিচার চলছে নিম্ন আদালতে।

৩২ বছর বয়সী রাজীব শাহবাগ আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাকে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে তার নিজের বাসার কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

২ বছর পর ঢাকার আদালত রাজীবকে হত্যা করার জন্য ২জন এবিটি সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড ও আরও ৬ কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়।

২০১৭ সালের ২ এপ্রিল হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন।

তবে রাজীবের বাবা নাজিমউদ্দীন হাইকোর্টের রায়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, তিনি ন্যায়বিচার পাননি।

এই মামলার ক্ষেত্রেও আপিল বিভাগ এখনও হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের আপিলের শুনানি প্রক্রিয়া শুরু করেনি।

রাজীবের মৃত্যুর ১১ দিন পর আরেকটি হামলার ঘটনা ঘটে।

সেই ঘটনায়, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়কে ঢাবির টিএসসির কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেসময় তিনি এবং তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা একুশে বই মেলা থেকে বের হয়ে আসছিলেন। স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টায় বন্যা গুরুতর আহত হন।

অভিজিৎকে হত্যায় আদালত গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড ও আরেক জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এই মামলা এখনও হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

অনন্ত বিজয় দাসের মামলার অবস্থাও একইরকম।

২০১৫ সালের মে মাসে লেখক বিজয়কে সিলেটের সুবিদবাজারে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এবিটি পরে এই হত্যার দায় স্বীকার করে। কিন্তু রায় ঘোষণা করতে আদালত ৭ বছর সময় নেন।

এ বছরের ৩০ মার্চ সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এবিটির ৪ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ মামলাও হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।

২০১৬ সালের এপ্রিলে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারকর্মী জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয়কে জুলহাসের কলাবাগানের বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

জুলহাস তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী পত্রিকা 'রূপবান'-এর সম্পাদক এবং ইউএসএইডের সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন। তনয় ছিলেন থিয়েটার দল লোকনাট্য দলের একজন কর্মী।

গত বছরের ৩১ আগস্ট ঢাকার সন্ত্রাস দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল নিষিদ্ধ জঙ্গি দল আনসার-আল-ইসলামের ৬ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আসামিদের আপিল আবেদন এখন হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।

বাকি ৩ মামলার পরিস্থিতিও কোনো দিক দিয়ে আশাব্যঞ্জক নয়।

২০১৫ সালের ৩০ মার্চ এবিটির ৩ জঙ্গি রামদা দিয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় হত্যা করে। এই হত্যা মামলা এখনো ঢাকার একটি আদালতে বিচারাধীন আছে।

আরও ২ ব্লগারের হত্যাকাণ্ডে মামলা দায়ের করা হলেও বিচারিক কার্যক্রম এখনো শুরুই হয়নি। নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট গোরানে এবং নাজিম উদ্দিন সামাদকে ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল পুরান ঢাকায় হত্যা করা হয়।

নীলাদ্রি হত্যা মামলায় পুলিশ ১৩ জন এবিটি সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। এ বছরের ২২ জানুয়ারি, বিচারিক আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করেছে। আদালতের সূত্র মতে, অভিযোগ গঠনের পর রাষ্ট্রপক্ষের কোনো সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দিতে আসেনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র নাজিম উদ্দিন সামাদকে পুরান ঢাকায় কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট পুলিশ এই মামলায় আনসার আল ইসলামের ৯ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। তবে আদালত এখনো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করেননি।

রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতা

এ বিষয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, বাংলাদেশের যেকোনো ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এর তদন্ত করা, পাবলিক প্রসিকিউটরের মাধ্যমে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা এবং পুলিশের মতো এর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে সংগৃহীত সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ প্রদর্শন করা।

'আর এ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে', যোগ করেন তিনি।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, 'আমাদের দেশের বিচারকদের কোনো ইনকুইজিটরিয়াল ক্ষমতা থাকে না, কারণ তারা সাক্ষী বা প্রমাণ জোগাড় করেন না। এ কাজগুলো করেন রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন। সুতরাং, একটি মামলার কার্যক্রম দ্রুত আগাবে না ধীরে চলবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করে রাষ্ট্রপক্ষের ওপর।'

ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরাও এই দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে ক্ষুব্ধ। তারা আশঙ্কা করছেন, তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে।

ব্লগার অমি রহমান পিয়াল জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো বিভিন্ন আইনের কারণে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গেছে।

পিয়াল জানান, মুক্তমনা, ব্লগার ও ধর্মবিশ্বাসী নয় যারা, তারা এই সংকুচিত হতে থাকা পরিসরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অপরদিকে, ধর্মান্ধ ও মৌলবাদীরা বর্তমান পরিস্থিতিতে লাভবান হয়েছেন এবং তারা যেকোনো মানুষ ও তাদের লেখার বিরুদ্ধে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' হানার অভিযোগ আনতে পারেন।

'আমাদের কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা রয়েছে? মানুষ যা লিখতে অথবা বলতে চায়, তা পারে না। আমার আশঙ্কা, আগামী দিনগুলোতেও আমরা তা করতে পারব না। এটি একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং আমি এর আশু কোনো সমাধান দেখতে পাচ্ছি না', যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও জানান, সরকারের উচিত আরও শক্তিশালী উদ্যোগ নেওয়া, যাতে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। সবাই যাতে মত প্রকাশ করতে পারে এবং মত প্রকাশের জন্য কাউকে অভিযুক্ত করা না যায়, সেটা নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব।

এই প্রতিবেদন তৈরিতে প্রেস ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ সংক্রান্ত প্রকল্প থেকে সহযোগিতা পাওয়া গেছে।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

5h ago