শ্রম আদালত: সমাধানের চেয়ে ভোগান্তি বেশি

একটি মামলার রায় দেওয়ার জন্যে আইনানুযায়ী শ্রম আদালতের যে সময় নেওয়ার কথা, তার চেয়েও ১০ গুণ বেশি সময় নিয়ে রায় দেন এই আদালত।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) এক গবেষণায় এই বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও মৃত্যুর শিকার কর্মীদের পক্ষ থেকে দায়ের করা ৮০টি ক্ষতিপূরণ মামলা বিশ্লেষণ করেছে ব্লাস্ট। এই মামলাগুলোর রায় দিয়েছেন শ্রম আদালত।
‘টায়ার দেম আউট: চ্যালেঞ্জেস অব লিটিগেটিং কমপেনসেশান ক্লেইমস আন্ডার বাংলাদেশ লেবার অ্যাক্ট ২০০৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি থেকে জানা গেছে, শ্রম আদালত কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও মৃত্যুর মামলাগুলোর রায় দেওয়ার জন্যে গড়ে ৬০১ দিন সময় নিয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের শ্রম আদালত মামলার নিষ্পত্তির জন্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ সময় নিয়েছে; গড়ে এক হাজার ২৮০ দিন। এত দীর্ঘ অপেক্ষাও অনেক সময় ফলপ্রসূ হয় না। কারণ, নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিতভাবেই আদালতের রায়কে অবজ্ঞা করে। সেক্ষেত্রে কর্মীদেরকে ফৌজদারি মামলা করে তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হয় এবং এর জন্যে তাদেরকে আবারও আরেকটি সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিয়োগদাতারা রায় ঘোষণার পর ভুক্তভোগীকে টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে গড়ে ৪৭৫ দিন সময় নিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে একজন কর্মী বা কর্মীর পরিবারকে তাদের প্রাপ্য টাকা পেতে বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে মাত্র দুই লাখ (আহত হলে) থেকে আড়াই লাখ (নিহত হলে) টাকার মতো ছোট আকারের ক্ষতিপূরণের জন্যে তাদেরকে এত কিছু করতে হচ্ছে।
২০১৬ সালে শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছিল। এর আগে দায়ের করা মামলাগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এক লাখ থেকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকার মধ্যে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ: ২৮ বছর বয়সী জুয়েলকে ইতিবাচক রায়ের জন্যে চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তারপরেও তিনি তার নিয়োগদাতার কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থ আদায় করতে পারেননি।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এই নির্মাণ শ্রমিক ৬০ কেজি ওজনের বালু কাঁধে নিয়ে একটি দুর্বল মই বেয়ে ওঠার সময় পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি বাড্ডার একটি নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করার সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে।
পড়ে যাওয়ার পর তার কোমরের নিচ থেকে শরীরের সম্পূর্ণ অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। চিকিৎসকরা তাকে জানান, বাকি জীবন তিনি হাঁটতে বা কোনো ধরনের কায়িক শ্রম করতে পারবেন না, যা একজন তরুণ নির্মাণ শ্রমিকের জন্যে মৃত্যুদণ্ডের সমান।
দুর্ঘটনার সময় জুয়েল বাড়ির মালিক হাজী লিয়াকত আলীর অধীনে কাজ করছিলেন। জুয়েল ২০১৪ সালের জুনে লিয়াকতের বিরুদ্ধে দুই লাখ ১৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন।
দীর্ঘ চার বছর ধরে মামলা চলার পর জুয়েলের পক্ষে আদালত রায় দেন। কিন্তু, তাতেও কোনো কাজ হয়নি। আদালত লিয়াকত আলীকে দুই মাসের মধ্যে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু, ২০২১ সালে এসেও জুয়েল তার সাবেক নিয়োগকর্তার কাছ থেকে একটি টাকাও পাননি।
এরপর টাকাটি উদ্ধারের জন্যে লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা করে ব্লাস্ট। সে মামলাটিও আদালতে বিচারাধীন।
ব্লাস্টের গবেষণা কনসালট্যান্ট তাকবির হুদা প্রণীত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের শ্রম আইনটি দাবিদারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়োগদাতার সদিচ্ছার (সামর্থ্যের পরিবর্তে) ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণ দিতে বারবার অস্বীকৃতি জানানো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত এবং এক্ষেত্রে আইন অমান্য করা হলেও তাতে খুব সামান্য বা একেবারেই কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না তাদেরকে।’
রায় দেওয়ার জন্যে এত দীর্ঘ সময় লাগার পেছনে মূল কারণগুলো হচ্ছে— প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক বিচারক, পুরনো মামলার চাপ, লিপিবদ্ধ তথ্য-প্রমাণ পেতে সমস্যা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শ্রমিক ও আদালতের মধ্যের বড় ভৌগলিক দূরত্ব।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দাবিদারের উপজেলা থেকে শ্রম আদালতের (যেখানে ক্ষতিপূরণের দাবিটি পেশ করতে হবে) গড় দূরত্ব ২০১ কিলোমিটার।’
‘৮০টি মামলার মধ্যে ৫০টিতে আদালত ও দাবিদারের বাড়ি ভিন্ন জেলায় অবস্থিত ছিল। বিচারের জন্যে দাবিদারকে শত কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়, যা খুবই ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ।’
প্রতিবেদনটি আরও জানায়, সময় ও দূরত্বের কারণে শ্রমিক ও তাদের পরিবাররা অনেক সময় আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি করে নেয়।
২০০৭ সালে যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগে অবস্থিত থ্রি স্টার ফ্যান ফ্যাক্টরিতে কাজ করার সময় আগুনে পুড়ে নিহত হয় ১৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ রুবেল। পরের বছর রুবেলের মা একটি মামলা দায়ের করেন।
বিচার চলাকালে নিয়োগদাতা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে কোনো লিখিত বক্তব্যও দেয়নি। রুবেলের মা আদালতকে জানান, প্রতিষ্ঠানটি তাকে মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়েছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে।
দীর্ঘ দুই বছর পর, ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালত ২০১১ সালের ১২ জানুয়ারি মামলার রায়ে রুবেলের মা’কে বাকি ৯০ হাজার টাকা ৩০ দিনের মধ্যে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
নিয়োগদাতা আদালতের নির্দেশ অবজ্ঞা করে। যে কারণে ব্লাস্ট তাদের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করে।
এরপর কারখানাটি রুবেলের অভিভাবকদেরকে আদালতের বাইরে মামলাটির নিষ্পত্তি করার জন্যে ৬০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। রুবেলের অভিভাবকরা টাকাটি গ্রহণ করেন এবং নিয়োগদাতার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগটি প্রত্যাহার করে নেন।
প্রতিবেদনের ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, ‘প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যগুলো আমাদেরকে দেখাচ্ছে অন্যায়ের শিকার মানুষেরা, যারা কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও মৃত্যুর শিকার হয়েছেন, তারা শ্রম আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চাইতে গিয়ে ভিন্ন এক ধরনের অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন। ফলে আদালতে মামলা চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্যে অসম্ভব ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে।’
‘এ কারণে কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে একটি বীমা স্কিম চালু করা এখন সময়ের দাবি। যাতে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবাররা দ্রুত ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন।’
ব্লাস্টের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘শ্রম আইন কর্মীদের অধিকার রক্ষা করার জন্যে প্রণীত হয়েছিল। তবে, এত বছর পরেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, ক্ষতিপূরণ আদায় করা সহজ নয়। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ অবজ্ঞা করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আদালতে মামলাগুলো স্থগিত থাকা ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দেরির কারণে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পান না এবং হতাশ হয়ে পড়েন। বর্তমানে প্রচলিত আইনটিকে সংশোধন করে নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণের নিয়মটি উঠিয়ে দিতে হবে এবং আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে।’
সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর একেএম নাসিম বলেন, ‘প্রতিবেদন থেকে বেরিয়ে আসা তথ্যগুলো মর্মান্তিক হলেও এটি কিছু বিষয়কে নিশ্চিত করেছে, যেগুলো বহু বছর ধরেই আমাদের জানা। বস্তুত ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণ অবকাঠামোটি শ্রমিকদের উপকারে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। শ্রম আইন দ্রুত সংশোধন করা উচিত।’
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, ‘যারা শ্রমিকদের কায়িক শ্রম থেকে আসা লভ্যাংশ পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন, নিয়োগদার পাশাপাশি তাদেরকেও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্বের অংশ করে নেওয়া উচিত।’
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments