আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সিইসি, ইসি নিয়োগের দাবি

সংবিধান উপেক্ষা করে সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগের কোনো আইনি সুযোগ নেই, বলেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।
গতকাল সোমবার 'নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে তারা বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, দেশে এখনও সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। যদিও এই আইন প্রণয়নের জন্য সাংবিধানিক বিধান আছে।
এই আইনের অনুপস্থিতিতেই রাষ্ট্রপতি ২০১২ ও ২০১৭ সালে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন।
আইনবিদ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও অধিকার কর্মীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ওই ওয়েবিনারে তারা বলেন, এই ধরনের সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে 'দলের তোষামোদকারীদের' সুপারিশ করে থাকে।
ফলস্বরূপ, গেল ২টি নির্বাচন কমিশন যথাযথভাবে তাদের কার্য সম্পাদনে ব্যর্থ হয়েছে।
বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এই আইনের একটা খসড়াও তৈরি করেছে।
খসড়ায় একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটা সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি প্রশাসন চালাতে দক্ষ এবং সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও আইনি বিষয়ে জ্ঞান আছে এমন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন।
জ্যেষ্ঠ আইনবিদ ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য আমীর-উল-ইসলাম বলেন, আইন প্রণয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে করা উচিত।
সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া] বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।'
আমীর-উল-ইসলাম বলেন, 'এখানে নতুন কিছু করার সুযোগ সীমিত (আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত)…অন্য দেশগুলো কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, সেটা আমরা দেখতে পারি।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, অবসরপ্রাপ্ত কিংবা দায়িত্বরত বিচারপতিদের ভেতর থেকে সার্চ কমিটির প্রধানকে বাছাই করা উচিত হবে না। বরং তার অন্য ক্ষেত্র থেকে আসা উচিত। যার নির্বাচন ও প্রশাসন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আছে।
পাশাপাশি বিতর্কিত হয়ে ওঠার কারণে 'সার্চ কমিটি' নামটাই পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন তিনি।
আরেক আইনবিদ শাহদীন মালিক বলেন, 'সিইসি ও ইসি নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটির নামে সরকার জনগণের সঙ্গে চালাকি করছে। রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটি গঠনের কোনো ক্ষমতা নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া অন্য সব বিষয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই পরামর্শ করতে হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকার এমনভাবে সার্চ কমিটি গঠন করে যা নিজেদের পছন্দ মতো লোক বাছাই করে...এমন কোনো সার্চ কমিটির মাধ্যমে যদি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, তাহলে তা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে।'
যেহেতু আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে, তাই অনেকেই মনে করছেন নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় নেই।
তবে শাহদীন মালিক বলেন, সরকার ও সংসদ চাইলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আইনটি পাস করতে পারে।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সার্চ কমিটি তৈরি করা হয়েছে অ্যাডহক ভিত্তিতে। তার ভাষ্য, 'সার্চ কমিটিগুলো দলীয় নিরপেক্ষ লোকদের নিয়ে গঠন করা হয়নি। যারা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দলের তোষামোদকারীদেরই বাছাই করে। ফলে আমরা দেখেছি, শেষ ২টি কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, নানা অসঙ্গতিতে জড়িয়ে পড়েছে এবং একটা ভঙ্গুর নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরিতে অবদান রেখেছে।'
সুজন সম্পাদক এম হাফিজউদ্দিন খানের মতে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বলেন, 'শেষ দুটি সার্চ কমিটির কর্মকাণ্ডে মানুষ সন্তুষ্ট নয়। বর্তমান কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। ভোটাররা ভোট দিতে চায় না। কারণ তারা মনে করে ভোট দিয়ে কোনো লাভ নেই।'
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, সংবিধানের ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন তৈরি করা উচিত। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এ ধরনের আইন আছে। তিনি বলেন, 'আমাদের সময়ে আমরা এই আইনের একটা খসড়া তৈরি করেছিলাম। যা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, এটা নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি।'
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের অভিমত, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার ও শাসন ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসা উচিত।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সংবিধান এমন কোনো পবিত্র গ্রন্থ নয়, যা পরিবর্তন করা যাবে না। তার বক্তব্য, সংবিধান সব সময় পরিবর্তন করা যেতে পারে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধানের জন্য তিনি একটা জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব রাখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুলও নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সহমত পোষণ করেন। বলেন, 'বর্তমান সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করা দরকার। এটা হতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অথবা জাতীয় সরকার।'
আলোচনায় আরও অংশ নেন সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল, মানবাধিকার কর্মী শিরীন হক, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, বেসরকারি সংগঠন ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের আব্দুল আলিম, আর্টিকেল নাইনটিনের ফারুক ফয়সাল, সুজন নেতা অধ্যাপক সেকান্দার খান ও জাকির হোসেন।
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ।
Comments