‘আমাদের আরও অনেকটা পথচলা বাকি’

স্যার ফজলে হাসান আবেদের সৃষ্টি ব্র্যাক ৫০ বছরের যাত্রা পূর্ণ করেছে। তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র বিমোচন ও সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।
দ্য ডেইলি স্টার: ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ। তিনি আজ নেই। তার হাত ধরেই গড়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সময় তিনি সরাসরি এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমরা অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাই, বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি নির্ভর। ব্যক্তি যখন থাকেন তখন সেটা চলে, ব্যক্তি না থাকলে ঠিকঠাক চলে না। কিন্তু ব্র্যাকের ক্ষেত্রে আমরা ব্যতিক্রম দেখতে পাই। ব্র্যাক সদর্পে চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
আসিফ সালেহ: আমি স্যার ফজলে হাসান আবেদকে যত কাছ থেকে দেখেছি, তাতে বুঝেছি যে তিনি সবসময় প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিকীকরনের ওপর বেশি জোর দিতেন। তিনি ব্যক্তি আবেদকে কখনো সামনে আনতে চাননি, সবসময় সামনে নিয়ে এসেছেন ব্র্যাককে। ব্র্যাকের একটি সমষ্টিগত নেতৃত্ব তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। ব্র্যাকের যে কাজগুলো মানুষ দেখেন তারচেয়ে অনেক বেশি কাজ ভেতরে হয়, যেটা মানুষ দেখেন না। সেটা হচ্ছে কর্মীদের প্রশিক্ষণ, দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, একটি সিস্টেম ও প্রসেস তৈরি করা। এই জিনিসগুলো হয়তো আমরা অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠানে দেখি। কিন্তু দেশীয় প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের সিস্টেম, প্রসেস ও দক্ষ ম্যানেজমেন্ট গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়ার বিষয়টি খুব কম দেখা যায়। আমার মনে হয় এ বিষয়ে তার প্রজ্ঞাটা আমাদের খুব কাজে দিয়েছে। কারণ ব্র্যাক এখন কিন্তু কোনো ব্যক্তির ইচ্ছায় চলে না। এখানে ম্যানেজমেন্ট আছে, ম্যানেজমেন্টকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সড রাখার জন্য একটি গভর্নিং বডি আছে, যেটা কিছু ইনডেপেনডেন্ট মানুষ নিয়ে তৈরি।
পাশাপাশি এখানে খুব শক্তিশালী ম্যানেজমেন্ট লাইনও আছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এখন যিনি আছেন, তার জায়গায় পরবর্তীতে যে আসবে তাকে প্রস্তুত করে তোলার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি। তার পেছনে বিনিয়োগ করছি। এর সবকিছুই আমরা তার (ফজলে হাসান আবেদ) কাছ থেকে শিখেছি।
সেদিক থেকে আমার মনে হয়, তার একটি পরিকল্পনা ছিল সবসময়। তিনি নিজে পদ ছেড়েছেন, একটি নতুন বোর্ডকে নিয়ে এসেছেন, পাশাপাশি ম্যানেজমেন্টকে সুযোগ দিয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকতেই এগুলো হয়েছে। সে কারণে এর একটা প্রাতিষ্ঠানিকীকরন হয়ে গেছে। যার কারণে ব্র্যাক আর ব্যক্তি নির্ভর নেই।
বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্র্যাকের যে ৪টি এনটিটি আছে সবগুলোকে একসঙ্গে করে আমাদের গ্লোবাল স্ট্রাটেজি ও বিশ্বব্যাপী ব্র্যাককে সম্প্রসারণের কর্মকৌশল ঠিক করতে একটা বোর্ড তৈরি হচ্ছে।
এদিক থেকে আমাদের মনে হয়, উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে এ ধরনের উদাহরণ খুব একটা নেই। আমরা পশ্চিমা বিশ্বে বিভিন্ন সংগঠনে এমনটি দেখি। সেদিক থেকে ব্র্যাকের এই পথচলা নতুন কিছু দিক উন্মোচন করছে। সবার এখন আমাদের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ। আমরা উন্নয়ন বা ডেভেলপমেন্ট স্পেস যেটাকে বলি, তা মূলত দাননির্ভর। সেখান থেকে বের হয়ে কীভাবে স্বাবলম্বী হয়ে এত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড একটি প্রতিষ্ঠান করতে পারে, তার একটি উদাহরণ এখন ব্র্যাক। এ কারণেই আমার মনে হয়, আমাদের আরও অনেকটা পথচলা বাকি।
আমাদের প্রতিষ্ঠাতা দেখিয়ে গেছেন, আমাদের অ্যাম্বিশন আছে অনেক বেশি। সেই অ্যাম্বিশনটা হচ্ছে, ব্র্যাক যে ভিশন নিয়ে বাংলাদেশে অনেক সমস্যা সমাধান ও মানুষের বিকাশের চেষ্টা করেছে, সেই একই মন্ত্রে বিশ্বজুড়ে আরও বড় পরিসরে কাজ করবে ব্র্যাক।
একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি গর্বিত যে, বাংলাদেশি একটি সংস্থা হিসেবে ব্র্যাক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার কর্মকৌশল ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর একটা উদাহরণ হতে পারে আমাদের আলট্রা পুওর গ্রাজুয়েশন মডেল। যেটার কথা অনেকেই প্রথমবারের মতো শুনেছিলেন, অভিজিৎ ব্যানার্জি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন এর ওপর গবেষণা করে। সেই মডেলটি এখন বিশ্বের প্রায় ৪৬টি দেশে বিভিন্নভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। আমাদের নিজস্ব একটি কর্মসূচি আছে, যেখানে আমরা বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করছি এই আলট্রা পুওর গ্রুপটাকে আরও এগিয়ে নিতে। আমাদের লক্ষ্য তাদের এমন একটি জায়গায় পৌঁছে দেওয়া, যাতে তাদেরকে আর সাহায্য করতে না হয়। তাই এটা একটা ইউনিক মডেল।
আমাদের স্কুল মডেল আছে। আমরা এখন নতুন নতুন মডেল নিয়ে কাজ করছি, দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছি। পাশাপাশি শহুরে দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নতুন নতুন কাজের জায়গা তৈরি হচ্ছে। কারণ বিশ্বে অনেক পরিবর্তন হচ্ছে, বাংলাদেশে অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। সেই জায়গাগুলোতেও আমরা কিছু কিছু মডেল তৈরি করার চেষ্টা করছি। আশা করছি এগুলোকেও বিশ্বজুড়ে সম্প্রসারিত করা সম্ভব।
ডেইলি স্টার: বাংলাদেশের একটি এনজিও প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে কাজ করছে, এটা খুব আগ্রহ জাগানিয়া ব্যাপার। কীভাবে এই যাত্রাটা শুরু হলো? যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশে ব্র্যাক ঠিক কী কাজ করছে?
আসিফ সালেহ: আমরা মূলত কাজ করছি এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র ১১টি দেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে আমাদের যে এনটিটিগুলো আছে, তা কাজ করে মূলত তহবিল সংগ্রহের জন্য। ওই দেশগুলোর পোভার্টি পকেটগুলোতে কাজ করার সুযোগ আমাদের ছিল। কিন্তু আমরা ইচ্ছা করেই সেটা অ্যাভয়েড করেছি। যাতে আমরা মূল ফোকাস থেকে না সরে যাই।
আমরা যদি আমাদের দেশের দারিদ্র্যের কথা চিন্তা করি, বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার কমানোর ক্ষেত্রে একটা নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আফ্রিকার অনেক দেশ সেই যায়গায় যেতে পারেনি। আমাদের ভিশন যেহেতু বিশ্বের প্রতিটি মানুষের সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো, সেদিক থেকে চিন্তা করলে আগামী দিনগুলোতে আফ্রিকা এবং অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলোতেই আমাদের কাজ হবে।
২০০২ সালে আফগানিস্তানে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল কাজ শুরু করে। আমাদের অনেকেই বলেছিলেন, আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু আফগানিস্তানে আমাদের প্রোগ্রাম খুব ভালোভাবেই কাজ করেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা খুব সাহসী ছিলেন। তিনি অনেক ঝুঁকি নিতেন। তিনি মনে করতেন মানুষের প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়ানো খুব জরুরি। যার সবচেয়ে জরুরি সাহায্যের প্রয়োজন তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। এই চিন্তা থেকেই তিনি 'না' এর চেয়ে 'হ্যাঁ' বেশি পছন্দ করতেন এবং তিনি কারণ খুঁজতেন যে কীভাবে যাওয়া যায়।
একটা সমালোচনা আমি প্রায়ই শুনি যে ব্র্যাক একটা প্যারালাল সরকার কি না। কেন ব্র্যাকের স্কুলে এত ছেলেমেয়ে গেছে। একটা সময় ব্র্যাক ৬৪ হাজার স্কুল চালিয়েছে।
ফজলে হাসান আবেদ সবসময় বলতেন, একটা সময় সব জায়গায় সরকারি স্কুল হবে। কবে সরকারি স্কুল হবে সেই চিন্তা থেকে আমরা একটা প্রজন্মকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করলে তা অনুচিত হতো। আদর্শিক জায়গা থেকে চিন্তা করলে—এটা অবশ্যই সরকারের কাজ। কিন্তু অনেক সময় সরকারের সামর্থ্য কম থাকে। এর জন্যই বেসরকারি সংগঠনগুলো সামনে এগিয়ে আসে। আমার মনে হয়, যে দেশেই হোক, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বড় ধরনের তাড়না সব সময় তার মধ্যে ছিল। সেই ভাবনা থেকেই ব্র্যাক উগান্ডায় গেছে। ব্র্যাক এখন সেখানে সবচেয়ে বড় এনজিও। উগান্ডায় এখন আমাদের একটা ব্যাংক আছে। এই ধরনের কাজগুলো করতে অনেক বড় সাহস লাগে। এই সাহস তার ছিল এবং তিনি ঝুঁকিটাও নিয়েছেন। বেশিরভাগ উদ্যোগ সফল হয়েছে, আবার কিছু উদ্যোগ ব্যর্থও হয়েছে। এর নামই ঝুঁকি নেওয়া। কিন্তু ঝুঁকি না নিয়ে বসে থাকা তিনি একদমই পছন্দ করতেন না।
আমার মনে হয়, সংগঠন হিসেবে ব্র্যাক আগামী দিনগুলোতেও এমন ঝুঁকি নেবে, ভুল করবে, ভুল থেকে শিখবে। এভাবেই পথ চলবে।
ডেইলি স্টার: আমরা সাহায্য সংস্থা বা এনজিও বলতে যা বুঝি, ব্র্যাক এর থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। যেমন, ব্র্যাকের আড়ং, ব্র্যাক ডেইরি, ব্র্যাক ব্যাংকের মতো কিছু সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ বাণিজ্যিকভাবে চলে। এটা এক ধরনের নতুন মডেল। এর সূত্রপাত হয়েছিল কীভাবে এবং এটা কীভাবে চলে?
আসিফ সালেহ: ব্র্যাকের কাজ মূলত ৪টি ধারায় বিভক্ত। একটা দাতাগোষ্ঠীর সাহায্যে চলে। যেমন, আমরা বিনা খরচের স্কুল চালাই। অতি দরিদ্রদের জন্য একটা বিশাল প্রোগ্রাম আছে। এগুলো মূলত ভর্তুকি দিয়ে চলে। সেখান থেকে কোনো অর্থ আয় হয় না। ওই খরচটা অন্যান্য জায়গা থেকে ব্যবস্থা করতে হয়। সেই অর্থটা আসে মূলত দাতাগোষ্ঠী থেকে এবং ব্র্যাকের নিজস্ব উৎস থেকে। অতি দরিদ্রদের কর্মসূচিতে আমরা প্রতি বছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করি। এই টাকার বড় একটা অংশ ব্র্যাক এবং দাতাদের কাছ থেকে আসে।
দ্বিতীয় ধারাটা হলো আমাদের সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ। এগুলো আলাদা কোনো সংগঠন না। এগুলো ব্র্যাকের ভেতরে থেকেই আলাদা ব্র্যান্ড হিসেবে কাজ করছে। এর একটি আড়ং। এটা কিন্তু আলাদা কোনো সংগঠন না। এটা ব্র্যাকের মধ্যে থেকেই কাজ করে। আড়ং বা অন্যান্য সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের শুরু হয়েছিল মানুষের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্য নিয়েই। এটাকে মুনাফার জন্য কখনো চিন্তা করা হয়নি। গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের জন্যই এর শুরু। সেখানে অনেক শিল্পী আছেন, তাঁতি আছেন, কিন্তু বাজার ছিল না। তাদের বাজার সম্প্রসারণ ও কাজের ব্যবস্থা করার তাগিদ থেকেই আড়ংয়ের যাত্রা শুরু। এখানে প্রায় ৬৫ হাজার শিল্পী বিভিন্নভাবে যুক্ত আছেন।
এটাকে আমরা কমার্শিয়াল না বলে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ বলি। কারণ, এর মুনাফা কারও পকেটে যায় না। এর কিছুটা খরচ হয় প্রতিষ্ঠানটির সম্প্রসারণে এবং কিছুটা আসে ব্র্যাকে। অতি দরিদ্রদের জন্য যে কাজগুলো হয় তার কিছুটা অর্থের সংস্থান হয় এখান থেকে। এখানে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তগুলো সর্বোচ্চ মুনাফা করার জন্য নেওয়া হয় না।
দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় থাকা শিল্পীদের কাছ থেকে জিনিসপত্র আনতে হয়। তাদেরকে কাঁচামাল ও প্রশিক্ষণ দিয়ে পণ্য উৎপাদন হয়। এটার পেছনে যে বিশাল খরচ সেটা মাথায় রেখে যদি সর্বোচ্চ মুনাফার কথা চিন্তা করা হতো, তাহলে আমরা ঢাকার আশপাশ থেকে এই পণ্য উৎপাদন করাতে পারতাম। আমরা তা করি না। কেননা আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, অতি দরিদ্র এলাকাগুলোতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এভাবে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজগুলো কমার্শিয়াল এন্টারপ্রাইজ থেকে আলাদা।
তিন নম্বর ধারা হলো আমাদের সামাজিক বিনিয়োগ, যেগুলো আলাদা ম্যানেজমেন্টের আওতায় চলে এবং এগুলো আলাদা সংগঠন। এর মধ্যে আছে ব্র্যাক ব্যাংক। এর শুরু হয়েছিল এসএমই খাতে ঋণ দেওয়ার জন্য। ২০০১ সালে যখন এটি শুরু হয়, তখন আমাদের এসএমই খাতকে কোনো ব্যাংক ঋণ দিত না এবং তাদের অনেক ঝুঁকিপূর্ণ মনে করত। আমাদের মাইক্রোফাইন্যান্স থেকে দেখলাম, এখানে অনেক চাহিদা আছে। কিন্তু মাইক্রোফাইন্যান্স একটা নির্দিষ্ট অংকের বেশি ঋণ দিতে পারে না। তাদেরকে সহায়তার জন্য ব্র্যাক ব্যাংক শুরু হয়। ব্র্যাক ব্যাংকের মুনাফার অংশ পায় এর শেয়ারহোল্ডাররা। ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার হিসেবে ব্র্যাক সেখান থেকে মুনাফার অংশ পায়। সেই টাকাটা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হয়।
আমাদের চতুর্থ ধারা হলো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। এটাও আলাদা ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে চলে, তবে মুনাফার উদ্দেশ্যে নয়।
ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালও সেরকম আলাদা ধারায় চলে। ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের হেড অফিস বাংলাদেশে, কিন্তু রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয়েছে নেদারল্যান্ডসে। এটা খুবই অভিনব একটি মডেল। আপনারা জানেন, বিদেশি সাহায্য এখন বিভিন্নভাবে কমে যাচ্ছে। একেতো বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে, সেইসঙ্গে পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের সংঘাত চলতে থাকায় মানবিক সহায়তার অর্থগুলো সেদিকে চলে যাচ্ছে। ইউক্রেনের শরণার্থীদের সহায়তার জন্য দাতাদের টাকা যাবে। কিন্তু তার মানে এই না যে বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে অর্থসংস্থান করতে হবে। আমাদের যেহেতু বিভিন্ন ধারা থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আসছে, তাই আমরা অনেক বেশি স্বাবলম্বী। আমাদের বৈদেশিক দানের ওপর পূর্ণ মাত্রায় নির্ভর করতে হয় না। এটা দিয়ে আমরা আমাদের কাজের অর্থায়ন করব। একসময় সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়ন কাজগুলো চালিয়ে যাব।
ডেইলি স্টার: এ ক্ষেত্রে অনেকে সমালোচনা করার চেষ্টা করেন যে ব্র্যাক অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করে না। এই সমালোচনার জবাব কীভাবে দেবেন?
আসিফ সালেহ: বিভিন্ন এনজিওর বিভিন্ন ভূমিকা। এনজিওদের সবাইকে এক কাতারে ফেলা যাবে না। আমার মনে হয়, কিছু এনজিও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করবে। কিছু এনজিও সার্ভিসে কাজ করবে। আমরা মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন নিয়ে কাজ করাটাকে প্রয়োজন মনে করেছি। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এবং সত্তরের দশকে যারা কাজ করেছেন তারা মূলত বাম আদর্শ থেকে এসেছেন। ব্র্যাক শুরু হয়েছে পাওলো ফ্রেইরি নামে একজন দার্শনিকের চিন্তা থেকে। তিনি মনে করতেন, মানুষই সব ক্ষমতার উৎস। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সব সময় সেটা বিশ্বাস করতেন। তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, কিন্তু সরাসরি সম্মুখ লড়াই বা বিপ্লবের দিকে যাননি। মানুষের ক্ষমতা বিকাশে যা দরকার তার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছেন।
মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের করে আনা কিন্তু একদিনে সম্ভব হয়নি। এর জন্য অনেক দিন ধরে ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝিয়ে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হয়েছে। এটা অনেক বড় কাজ হয়েছে। এর একটা বড় ফল আমরা দেখেছি। এর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজই হয়েছে। কিন্তু চিরাচরিত অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যমে হয়নি। আমার কাছে মনে হয় সব ধরনের কাজেরই প্রয়োজন আছে। লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি, অ্যাক্টিভিজম বা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করারও প্রয়োজন আছে। এর পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জীবনকে যদি একটু সহজ করা যায়, এর মাধ্যমেও মানুষ অনেক কিছু করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয় ব্র্যাক সেই কাজটিই করতে চেয়েছে এবং অনেক বড় আকারে করতে চেয়েছে। আমাদের এটাও ভাবতে হয়েছে যে, সরকারে যেই থাকুক না কেন আমাদের সবার সঙ্গেই কাজ করে যেতে হবে। এই কারণে সব সময় আমাদের কাজ মানুষকেন্দ্রীক।
আমার কাছে মনে হয়, ব্র্যাকের কাছে মানুষের অনেক বেশি আশা। আমিও প্রায়ই শুনি, ব্র্যাক এটা করে না কেন, ওটা করে না কেন। আমার মনে হয়, একটা সংগঠনের ফোকাস থাকা উচিত। একটা সংগঠন দিয়ে সব কাজ হয় না। সব চিন্তা করেই আমাদের কর্মকৌশল ঠিক করতে হয়।
ডেইলি স্টার: ব্র্যাক যে বিষয়গুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে—শিক্ষা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন। ৫০ বছর পরে এই জায়গাগুলোয় কতটুকু গুণগত পরিবর্তন হয়েছে বা সামনে কতটুকু চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন।
আসিফ সালেহ: ৫০ বছর পূর্তিতে আমি ৭০ এর দশকের পুরনো কিছু ছবি দেখছিলাম। বাংলাদেশের সেই সময় গ্রামের চিত্র যদি দেখেন, একসময় আমরা রৌমারীতে খিচুড়ি রান্না করে হাজারো মানুষকে খাইয়েছি। সেই জায়গা থেকে কিন্তু বাংলাদেশের অভাবনীয় উত্তরণ ঘটেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র বিমোচন—সবগুলো ইনডিকেটরের দিকে দেখবেন আমাদের ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। এখন ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে চিন্তা করি—এরপরে কী হবে? এক সময় আমরা মানুষকে মৌলিক সেবা দিতে পারতাম না। এক সময় ব্র্যাক ৬৪ হাজার স্কুল করেছে, কারণ পর্যাপ্ত সরকারি স্কুল ছিল না। এখন অনেক সরকারি স্কুল হয়েছে। তাই এখন আমদের স্কুলের সংখ্যা কমিয়ে ৬-৭ হাজারে নামিয়ে এনেছি। যে সব জায়গায় সরকারি স্কুল নেই, শুধু সেখানে আমাদের স্কুল করছি। বলা যায়, এই সেবার দিক থেকে আমরা অনেকটাই এগিয়েছি।
এরপরের ধাপ হলো মানসম্মত সেবা পাওয়া। আমরা শিক্ষা পাচ্ছি, স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছি, কিন্তু এর গুণগত মানটা কেমন? এখন এই জায়গায় অনেক কাজ করার আছে। এভাবেই একটা জাতি এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ যেন মনে করেন, তার এগিয়ে যাওয়ার একটা সিঁড়ি আছে এবং সেটা কারও দাক্ষিণ্যের জন্য অপেক্ষা করে না। তারা নিজেরা শিক্ষা নিয়ে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাবেন। বাবা দরিদ্র হলেও নিজে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসবেন, এই স্বপ্ন প্রতিটা মানুষ দেখেন। সেই স্বপ্নটা বাস্তবায়নের জন্য সমতাপূর্ণ সুযোগ আছে কিনা সেটা নিশ্চিত করা আমাদের আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এখন এই প্রশ্নটাই আমাদেরকে করতে হবে। অতি ধনী ও অতি দরিদ্রদের জন্য বাংলাদেশে ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যারা মাঝামাঝি পর্যায়ে আছেন তাদের মানসম্মত সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আগামী দিনগুলোতে ব্র্যাকের অনেক কিছু করার আছে বলে আমি মনে করি। যেখানে মানুষ অর্থ খরচ করেও মানসম্মত সেবা পাচ্ছে না, সেখানে আমাদের মতো সংগঠনের কাজ করার সুযোগ আছে। অতি দরিদ্রদের জন্য কাজ করতেই হবে, সেই সঙ্গে যেখানে সরকারি উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে বা অর্থ খরচ করেও বেসরকারি খাত থেকে মানসম্মত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে সামাজিক সংগঠন হিসেবে স্বল্প খরচে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা যায়। মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি—এই ধরনের জিনিসগুলো বাংলাদেশের মানুষ এখন বেশি করে চাইছে।
ডেইলি স্টার: গত ২ বছরে মহামারিতে বিশ্বজুড়ে ১০ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। বাংলাদেশেও লাখো মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে ব্র্যাকের মতো সংগঠনগুলোর নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন কি?
আসিফ সালেহ: আমার মনে হয়, আমাদের কাজ অনেক বেড়েছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আমাদের অনেক বেশি কাজ করতে হবে। কিন্তু অর্থসংস্থান কমেছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তার মানে, এখন বেশি কাজ করতে হলে আমাদের অনেকের সঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকার যদি একটু পরিকল্পনা করে, কীভাবে একজন আরেকজনের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে সেটা নির্ধারণ পারি, তাহলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। তবে এখন যে নতুন দরিদ্র তৈরি হয়েছে, তাদের লম্বা সময় সহযোগিতা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমরা ৮০ হাজার মানুষকে সহায়তা দিয়ে দেখেছি, তারা খুব দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছেন। আমরা আরেকটা ধারা দেখতে পাচ্ছি যারা শহর থেকে ফিরে গিয়েছিলেন। তারা যখন গ্রামে গিয়ে আবার ওই সাপোর্টগুলো পাচ্ছেন তারা আর শহরে ফিরতে চাইছেন না। এটা খুব ভালো একটা দিক। গ্রামের মানুষ একটা কমিউনিটি সাপোর্ট পায়। কিন্তু যারা শহরে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, তাদের সহায়তা দেওয়া সবচেয়ে কষ্টকর। এই মানুষগুলোকে চিহ্নিত করে সহায়তার আওতায় আনতে আমাদের মতো সংগঠনগুলো খুব ভালো কাজ করতে পারবে। সঠিক মানুষ যেন সঠিক সময়ে সঠিক সাহায্যটা পায়—এর ওপর আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দেই।
ডেইলি স্টার: পৃথিবী জুড়ে নতুন নতুন সংকট দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নিরাপত্তা ও যুদ্ধকে ঘিরে নতুন মেরুকরণ তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক নতুন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ব্র্যাক কী আহ্বান রাখবে।
আসিফ সালেহ: প্রতিনিয়ত মানুষ সৃষ্ট বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করা একটা নতুন বাস্তবতা বলে আমার মনে হয়। ২০২০ সালের কথা যদি চিন্তা করেন, মহামারি থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বেই এই সংকট বাড়ছে। এই সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের এর জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। সেটা বিমার মাধ্যমে হতে পারে। সাহায্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তুতি থাকতে হবে। রোহিঙ্গারা যে সময়ে এখানে আছে, সেটা যেন নষ্ট না হয় সেজন্য মানবিক সহায়তার সঙ্গে উন্নয়নকে সমন্বয়ের ব্যাপারেও ব্র্যাক দক্ষতা অর্জন করছে। আমাদের কক্সবাজারের এই দক্ষতাটা আমরা আফগানিস্তানে কাজ লাগাচ্ছি।
আমার আহ্বান হবে, সরকারের এগিয়ে আসার পাশাপাশি পৃথিবীর বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও যেন আগামী দিনগুলোতে নিজেদের দাতব্য কর্মকাণ্ডে যুক্ত করেন।
ডেইলি স্টার: ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশবাসীর উদ্দেশে আপনার কী বার্তা?
আসিফ সালেহ: ব্র্যাকের সুবর্ণজয়ন্তীতে পৌঁছানোর এই যাত্রা কখনোই সম্ভব হতো না, যদি আমাদের কর্মী ও বাংলাদেশের মানুষ আমাদের পাশে না থাকতেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও ব্র্যাক একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ না হলে ব্র্যাক হতো না। আবার ব্র্যাক এতো সম্প্রসারিত না হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়ত আরও অসম হতো। সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতেও ব্র্যাক বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকার আশা রাখে। বিশেষ করে যারা সবচেয়ে পিছিয়ে আছে তাদের যেন তাদের এক কাতারে নিয়ে আসতে পারে ব্র্যাক। বাংলাদেশ যে সম্ভাবনার আলো দেখছে, সেই সম্ভাবনার ফল যেন সব মানুষ পায় সেজন্য ব্র্যাক কাজ করে যাবে।
Comments