ইউক্রেনের রণাঙ্গনে ক্যামেরা হাতে এক বাংলাদেশি

ইউক্রেনের পশ্চিমের ছোট একটি শহর চপ।
ইসমাইল ফেরদৌস।

ইউক্রেনের পশ্চিমের ছোট একটি শহর চপ।

সেখানে এসে ইসমাইল ফেরদৌস নিজ চোখে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি দেখতে পান।

পেশায় ফটোসাংবাদিক, ইসমাইল বিভিন্ন অঞ্চলে শরণার্থী সংকট নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন এবং হাজারো মানুষকে ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিতে দেখেছেন। সে মানুষদের এখন কোনো ঘর নেই এবং তারা এখন শরণার্থীর জীবনযাপন করছেন।

ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের সীমান্তের কাছে একটি শরণার্থী শিবিরে ভিকটর ও তার স্ত্রী আনা। ৩ মার্চ, ২০২২। © Ismail Ferdous/VU’ for Blind

গত বুধবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে ফোনে আলাপকালে ইসমাইল বলেন, 'আমি এ মুহূর্তে একটি রেলস্টেশনে বসে আছি। অনেক মানুষ অন্য কোনো দেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করছেন। আজ পর্যন্ত তারা একটি দেশের নাগরিক। আগামীকাল তারা সবাই শরণার্থী হয়ে যাবেন।'

'অজানার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে মানুষ তাদের প্রিয়জনদের আলিঙ্গন করছে। বিচ্ছেদ ও অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় তাদের কান্না অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। আমি গত কয়েক বছরের মধ্যে কোনো সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহ করতে যেয়ে এত আবেগপ্রবণ হইনি', যোগ করেন তিনি।

ফরাসি পত্রিকা 'ব্লাইন্ড' ইসমাইলকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মানবতার সংকটের বিস্তারিত সংবাদ সংগ্রহের কাজ দেয়। তিনি ১ মার্চ নিউইয়র্ক থেকে ওয়ারশ উড়ে যান।

ইসমাইল বলেন, 'একটি ডিফেন্স প্রেস ছাড়পত্রের জন্য আমার সম্পাদক ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠায়। এরপর আমি পোল্যান্ডের লুবলিনে অবস্থিত ইউক্রেনের কনসুলার কার্যালয় থেকে আমার ভিসা পাই।'

লুবলিন থেকে তিনি একটি ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে ৭ ঘণ্টা যাত্রার পর পোল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রজেমিসল শহরে পৌঁছান। 

সেখানে পৌঁছানোর পর তার মধ্যস্থতাকারী তাকে এই পার্বত্য শহরে একটি সাময়িক আবাসে নিয়ে যান। তিনিও অন্য অনেকের মতো কিয়েভ থেকে পালিয়ে পোল্যান্ডে এসেছেন।

প্রজেমিসলে ১ সপ্তাহ কাজ করার পর ঠিক হাঙ্গেরির ওপর পাশে অবস্থিত শহর চপে পৌঁছান। পোল্যান্ডের এই শহরে এ মুহূর্তে প্রায় ৫ হাজার বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনীয় নাগরিক আশ্রয় নিয়েছেন।

পোল্যান্ডের ওয়ারশতে শরণার্থীদের সরিয়ে নেওয়ার ট্রেনে এক মা ও সন্তানের চুম্বন। ৬ মার্চ, ২০২২। © Ismail Ferdous/VU’ for Blind

সেখানে এখন ইসমাইল ১৫ মিটার দীর্ঘ ও ১৮ মিটার প্রশস্ত একটি কক্ষে আরও ১০ জন মানুষের সঙ্গে থাকছেন।

পালিয়ে আসা মানুষদের সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি ইসমাইল সেখানে সামরিক উপকরণ দেখারও সুযোগ পান। অনেক সশস্ত্র ইউক্রেনীয় সেনা এবং ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সাধারণ মানুষকেও রাস্তায় টহল দিতে দেখেন তিনি।

তিনি বলেন, 'শহরে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হওয়া মানুষগুলো আতঙ্ক ও অবিশ্বাসের মধ্যে আছে। তারা সবাই রুশ গোয়েন্দাদের ভয়ে ভীত। আমি যে বিশেষ অনুমতি পেয়েছি, তার মাধ্যমে আমি কারফিউর মধ্যেও ছবি তোলার সুবিধা পাচ্ছি।'

পোল্যান্ডের কর্কজোয়ার কাছে একটি ট্রান্সফার পয়েন্টে ঘুমিয়ে আছে এক শিশু। ৪ মার্চ, ২০২২। © Ismail Ferdous/VU’ for Blind

এ সময় ইসমাইল ইতিবাচক কিছু বিষয়ও দেখতে পেয়েছেন, যা হৃদয়কে আন্দোলিত করে।

'এখানে মানুষ যেভাবে একে অপরকে সাহায্য করছে, তা মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। অন্যান্য জায়গায় সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহ করতে যেয়ে আমি এতটা মানবতাবোধ দেখিনি,' বলেন তিনি।

'আমি একটি স্কুলে যাই, যেখানে (বাস্তুচ্যুত) মানুষরা রাতে থাকেন। প্রতিদিন সকালে বর্ষীয়ান মানুষরা, বিশেষ করে যারা অবসরপ্রাপ্ত পেশাদার, স্কুলে এসে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে সহায়তা করেন। তারা বিছানার চাদর ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিস ধুয়ে নিয়ে আসেন যাতে পরেরদিন সেখানে যারা থাকতে আসবেন, তাদের কোনো সমস্যা না হয়,' বলেন তিনি।

ইউক্রেনের খারকিভের লুবা (মাঝে)। ৭১ বছর বয়সী লুবা পোল্যান্ডের প্রজেমিসলের একটি শরণার্থী আশ্রয়ে। ৬ মার্চ, ২০২২। © Ismail Ferdous/VU’ for Blind

অন্য একটি শহর থেকে চপে আসা একটি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তিনি এক কিশোরীর সঙ্গে কথা বলেন।

তিনি বলেন, 'প্রায় ১৪ বছর বয়সী মেয়েটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে। সে জানায়, সে ভবিষ্যতে একজন সাংবাদিক হতে চায়। আগে সে অর্থনীতিবিদ হতে চাইতো এবং সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াতে চাইতো, কিন্তু এই যুদ্ধে সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিজের চোখে দেখে সে নিজেও একই পেশায় যেতে অনুপ্রাণিত হয়েছে।'

ইসমাইল ইতোমধ্যে সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তে শরণার্থী সংকট, ফ্রান্স-ইংল্যান্ড সীমান্তের কালাইস বন্দরে শরণার্থী সংকট, লিবিয়া ও সিসিলির মধ্যে উপকূলীয় সীমান্তের কাছে ভূমধ্যসাগরীয় সংকট, মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তের সংকট এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন।

পোল্যান্ডের কর্কজোয়া পয়েন্টে পোষা বিড়ালের সঙ্গে এক মেয়ে। ২ মার্চ ২০২২। © Ismail Ferdous/VU’ for Blind

'এই অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকেই বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষ ঘটছে। এখান থেকে আমার উপলব্ধি হলো, যেকোনো যুদ্ধে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহায় এবং তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আমরা ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি দেখছি,' যোগ করেন ইসমাইল।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যে বিষয়টি তাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে, তা হচ্ছে, এই যুদ্ধ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের চেয়ে খুব একটি ভিন্ন নয়, কারণ ইউক্রেনও তাদের নিজেদের ভাষা ও ঐতিহ্যকে রুশ আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে।

ইসমাইল আরও বলেন, '২০১৯ সালে আমি যখন প্রথম সরেজমিনে ইউক্রেন পরিদর্শনে যাই, তখন দেশের স্থানীয় তরুণরা আমাকে জানিয়েছিল, এক দশক ধরে তাদের সংস্কৃতি পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেটি তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও গর্বের বিষয়গুলো, বিশেষ করে সঙ্গীত ও সাহিত্যকে পুনপ্রতিষ্ঠিত করে নিজেদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচিতি তৈরি করবে।

পোল্যান্ডের মেডিকা পয়েন্টের কাছে একটি বাসের জানালায় স্মাইলি আঁকছে এক শিশু। ২ মার্চ ২০২২। © Ismail Ferdous/VU’ for Blind

'এই যুদ্ধ তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভুতকে ধ্বংস করতে চায়, যেটি তাদের ৩০ বছর ধরে তাড়া করছে', যোগ করেন তিনি।

ইসমাইল জানান, তিনি নিজের চেষ্টায় ফটোগ্রাফি শিখেছেন। তিনি ২০১১ সালে সুন্দরবনের ছবি তোলার জন্য এবং দীর্ঘ মেয়াদে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার সংবাদ সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান।

এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের জন্য কাজ করেছেন, যার মধ্যে আছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ইকোনমিস্ট, ব্লুমবার্গ এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।

পোল্যান্ডের প্রজেমিসলের ট্রেন স্টেশনের ভিতরে। ১ মার্চ ২০২২। © Ismail Ferdous/VU’ for Blind

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান 

Comments

The Daily Star  | English

Social safety net to get wider and better

A top official of the ministry said the government would increase the number of beneficiaries in two major schemes – the old age allowance and the allowance for widows, deserted, or destitute women.

1h ago