কক্সবাজারে ৪ বছরে জন্ম নেওয়া শিশুর পরিসংখ্যান নেই

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া এক নবজাতক। ফাইল ফটো/ রাশেদ সুমন

২০১৭ সালে, রোহিঙ্গা সংকটের এক মাস পর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন সে অঞ্চলের জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়।

স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, রোহিঙ্গা নবজাতক ও শিশুরা যাতে নাগরিকত্ব লাভের জন্য প্রাথমিক নিবন্ধনটি জোগাড় করতে না পারে, সেজন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তে জেলার চারটি পৌরসভা ও ৭১টি ইউনিয়নের বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ রাষ্ট্রের মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে শিশুর জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক।

দুই বছর পর, ২০১৯ সালের নভেম্বরে হাইকোর্ট জেলা প্রশাসনকে আবারও জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করার নির্দেশ দেন। কিন্তু গত ৩ আগস্ট প্রকাশিত এসিএপিএসের (দ্য অ্যাসেসমেন্ট ক্যাপাসিটিজ প্রজেক্ট) একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কক্সবাজার, চকরিয়া, মহেশখালী ও টেকনাফ পৌরসভায় জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হলেও ৭১টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে মাত্র ১২টি হাইকোর্টের নির্দেশ মানছে।

এসিএপিএস একটি অলাভজনক প্রকল্প যার তদারকি করছে দ্য নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল, সেভ দ্য চিলড্রেন ও মার্সি কর্পস নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত কনসরটিয়াম।

ফলশ্রুতিতে, গত চার বছরে কক্সবাজার অঞ্চলে কয়টি বাংলাদেশি শিশু জন্ম নিয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।

জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান ২০২০ এর তথ্যে, হাইকোর্টের আদেশের সময় সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজ শুরু করেছিল, যার মধ্যে জেলার ক্যাম্পগুলোতে জন্ম নেওয়া শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

অপরদিকে, আশ্রয়দাতা সম্প্রদায় বাংলাদেশের নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে পরিচয়সূচক প্রাথমিক কাগজের অপেক্ষায় থেকেছে।

এসিএপিএসের রিপোর্টে কোন কোন ইউনিয়নে জন্ম নিবন্ধনের কাজ পুনরায় শুরু হয়নি, তার কোনো তালিকা দেওয়া হয়নি।

উখিয়া উপজেলার পালংখালী এরকম একটি ইউনিয়ন। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, এখানেই কুতুপালংয়ে বিশ্বের বৃহত্তম আশ্রয় শিবির অবস্থিত।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুরউদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'চার বছর ধরে আমাদের ইউনিয়নে জন্ম নিবন্ধন স্থগিত আছে। আমাকে এখনও পুনরায় জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করতে বলা হয়নি।'

আনুমানিক ৫০ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক পালংখালীতে বসবাস করেন।

চেয়ারম্যান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'আইন অনুযায়ী যে কোনো ইউনিয়ন জন্ম নিবন্ধন সনদ দিতে পারে। তবে দুঃখজনক হচ্ছে, আমার ইউনিয়নের জন্য আইনটি ভিন্ন। স্থানীয়রা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।'

গফুরউদ্দিন আরও জানান, লজিস্টিক কারণেও এই সেবাটি দেওয়া যাচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসন তাদের ভবনটি ব্যবহার করতে পারছে না কারণ সেটি বর্তমানে নিরাপত্তা সেবার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

চেয়ারম্যান বলেন, 'আমি আমার নিজের কার্যালয়ে বসতে পারছি না। আমি আমার নিজের বাসাকে অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম, কিন্তু সেটি একটি চেকপয়েন্টের পেছনে অবস্থিত এবং এ কারণে আমি যে সব মানুষদের সেবা দিচ্ছি, তারা খুব সহজে সেখানে যাতায়াত করতে পারবেন না।'

এসিএপিএস'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'তিন বছর ধরে স্থগিত থাকার (জন্ম নিবন্ধন) বিষয়টি বাস্তুচ্যুত ও আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে জানা গেছে।'

ইতোমধ্যে নাগরিকদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে 'বিলম্বিত নিবন্ধন' জরিমানা আদায় করা হচ্ছে, যদিও প্রশাসনের সিদ্ধান্তেই জন্ম নিবন্ধন এতদিন স্থগিত ছিল।

রামু উপজেলার চাকমারকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সিকদার জানান, তার ইউনিয়নে দুই থেকে তিন মাস আগে থেকে জন্ম নিবন্ধন আবারও শুরু হয়েছে।

নুরুল বলেন, 'মানুষকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে এবং তারা ভীষণ রাগান্বিত। তারা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারেনি, বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারেনি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিয়ে করতে গিয়েও তাদের সমস্যা পড়তে হয়েছে।'

নুরুল ইসলামের কাছে জানতে চাই, '২০১৯ সালে হাইকোর্টের আদেশ এলেও কেন জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম তারা মাত্রই শুরু করলেন?'

তিনি বলেন, 'উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপকমিশনারের কার্যালয় থেকে আমাদের জানানোর পর আমরা আবেদনপত্র জমা নিতে শুরু করেছি।'

জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি আবারও শুরু হলেও সেটি ঝামেলামুক্ত থাকেনি। কক্সবাজারের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা জানান, নিজেদের স্থানীয় প্রমাণ করার জন্য বাসিন্দাদের কাছে অতিরিক্ত কাগজপত্র চাওয়া হচ্ছে, যার অনেকগুলোই তাদের কাছে নেই।

এসিএপিএস'র প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, 'স্থগিতাদেশের আগে আবেদনপত্রগুলো একজন রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দেওয়া হতো, যিনি তার অঞ্চলের সব বাসিন্দাদের চেনেন। এ কারণে রেফারেন্স প্রক্রিয়াতে খুব বেশি সময় লাগতো না। ২০২০ সালে যখন নিবন্ধন প্রক্রিয়া আবারও চালু হলো, তখন সব জন্ম নিবন্ধন আবেদনপত্রের কাজ শেষ করার জন্য জেলা ও উপজেলা রেজিস্ট্রারের আওতায় নতুন কমিটি গঠন করা হয়।'

ইউনিয়নগুলোর জন্য উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানই হচ্ছে রেজিস্ট্রার।

পালংখালী'র গফুরউদ্দিন বলেন, 'নিবন্ধনের জন্য প্রায় ২৭ অথবা ২৮ ধরনের কাগজের প্রয়োজন হয়।'

সদ্যজাত শিশুর জন্ম নিবন্ধনের সময় অভিভাবকদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধন সনদেরও প্রয়োজন হয়।

৪০ বছর বয়সী এনজিও কর্মী তাহের মাহমুদের কন্যা সন্তানটি ১০ মাস আগে জন্ম নিলেও তিনি এখনও তার জন্ম নিবন্ধন সনদের ব্যবস্থা করতে পারেননি।

তাহের বলেন, 'আমার মেয়ের বয়স যখন ৪১ দিন, আমি তখনই আবেদন করি। আমি জানি না কবে সেটি হাতে পাবো। তারা আমার ও আমার স্ত্রীর এনআইডি কার্ড এবং আমাদের বাবা মায়ের জন্ম নিবন্ধন সনদ চেয়েছে। আমি তাদেরকে বাবা মায়ের সনদগুলো দিতে পারিনি।'

তিনি আরও বলেন, 'এছাড়াও, আমার জন্ম নিবন্ধনটি ডিজিটাল নয়। আমি সেটাকে ডিজিটাল করার জন্য একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। আমার সনদটি ডিজিটাল হলেই তবে তারা আমার মেয়ের আবেদনপত্রটি বিবেচনা করবেন।'

ডিজিটাল করা বলতে তিনি অনলাইন জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়ার কথা বুঝিয়েছেন, যেটি ২০১০ সালে চালু করা হয়েছিল।

বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন জানান, যদি অভিভাবকদের জন্ম নিবন্ধন না থাকে, তাহলে তাদের সন্তানরাও সেটি পাবে না।

ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান অভিভাবকদের কাছে সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলে কী হবে, তা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, 'তাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় থাকতে হবে। আমি যদি আপনাকে চিনি, তাহলে আমি সাহায্য করতে পারবো। যদি আমি আপনাকে না চিনি, তাহলে আমি সাহায্য করতে পারবো না।'

এসিএপিএসের প্রতিবেদন এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় চার বছর ধরে জন্ম নিবন্ধন বন্ধ থাকায় সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো পুরনো আবেদনপত্রগুলো নিয়ে চাপে আছেন।

টিপু সুলতান জানান, 'জন্ম নিবন্ধন মাত্র কয়েক মাস আগে আবারও শুরু হয়েছে, কিন্তু উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিবর্তনের কারণে সেটি সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায়। প্রক্রিয়াটি আগামী মাস থেকে আবারও শুরু হবে। ইতোমধ্যে অন্তত এক হাজার আবেদনপত্র জমা আছে।'

তার ইউনিয়নে প্রায় ৭০ হাজার স্থানীয় বাসিন্দা আছেন।

আজিজ উদ্দিন জানান, তার আরও ছয় মাস সময় লাগবে শুধুমাত্র কী পরিমাণ আবেদনপত্র নিয়ে তারা কাজ করবেন, সেটি নির্ধারণ করতে। এরপর আরও এক থেকে দুই বছর লাগবে প্রক্রিয়াটিকে সঠিকভাবে চালু করার জন্য।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।

Comments

The Daily Star  | English

Over 14 million people could die from US foreign aid cuts: study

USAID had provided over 40 percent of global humanitarian funding until Trump returned to White House

13m ago