পতিত জমিতে মটরশুঁটি চাষ, কৃষকের মুখে হাসি

কয়েক বছর আগেও রোপা আমন ধান কাটার পর বোরো ধান রোপনের আগ পর্যন্ত নাটোর জেলায় প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকতো। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি রোপা আমন কাটার পর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি বোরো ধান রোপনের আগে কোনো ফসলের জীবনচক্র ২ মাস না থাকায় আবাদ করা যেতো না।
তবে বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন পতিত জমিতে চাষ হচ্ছে মটরশুঁটি। এতে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে মাটির উর্বরতা।
রবি শস্য খেসারি, সরিষা, রাই জাতীয় ফসলের জীবনচক্র ১২০ দিনের বেশি। মটরশুঁটির জীবনচক্র ৬০ দিন থেকে ৬৫ দিন হওয়ায় অনায়াসে বোরো আবাদও করতে পারছেন কৃষকরা। গৃহস্থালির কাজ শেষে মটরশুঁটির ফল তুলে বাড়তি আয় করে সংসারে অবদান রাখছেন গ্রামের নারীরা।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মেহে-দুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রোপা আমন কাটার পর প্রায় ৬০ দিন পরে ওই জমিতে বোরো ধান রোপনের সময় চলে আসে। রোপা আমনের পর জমিতে সরিষা, রাই, এবং খেসারি জাতীয় ফসল আবাদ করলে বোরো ধান দেরি হতো। কেননা এসব ফসলের জীবনচক্র প্রায় ১০০-১২০ দিনের মতো। ফলে আমন এবং বোরো ধানের মাঝখানে নাটোরের বেশিরভাগ কৃষক জমি পতিত রাখতেন।'
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি রোপা আমন কাটা হয়। এরপর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বোরো রোপন শুরু হয়। কিন্তু মটরশুঁটির জীবনচক্র ৬০ দিন থেকে ৬৫ দিন হওয়ায় কৃষকরা তাদের জমিতে মটরশুঁটি আবাদ করে অনায়াসে বোরো ধান চাষ করতে পারেন। রোপা ধান কাটার ১০-১৫ দিন আগে কাদাযুক্ত জমিতে মটরশুঁটি ছিটিয়ে দিলেই ধান কাটার পর জমিতে মটরশুঁটির গাছে ভরে যায়। মটরশুঁটি আবাদে তেমন কোনো খরচ নেই এবং বাজারদর ভাল। সে কারণে মটরশুঁটিকে কৃষি বিভাগ 'চান্স ক্রপ' নাম দিয়েছেন।

নাটোর সদর উপজেলার বাঙ্গাবাড়িয়া গ্রামের মটরশুঁটি চাষি বেলাল হোসেন জানান, গত বছর রোপা আমন কাটার পর বোরো রোপনের আগ পর্যন্ত তার ২ বিঘা জমি পতিত ফেলে রেখেছিলেন। কিন্তু এ বছর ৪ হাজার টাকা খরচ করে ওই ২ বিঘা জমিতে মটরশুঁটি আবাদ করে ২৫ হাজার টাকার মটরশুঁটি বিক্রি করেছেন। মটরশুঁটি একটা বাড়তি ফসল তাই সব খরচ বাদ দিয়ে ২০ হাজার টাকা লাভ হওয়ায় তিনি খুশি।
একই উপজেলার চন্দ্রকলা গ্রামের চাষী কালাম উদ্দিন জানান, এক বিঘা জমিতে দেড় হাজার টাকা খরচ করে মটরশুঁটি আবাদ করে তিনি ১৫ হাজার টাকার মটরশুঁটি বিক্রি করেছেন। রোপা ধান পাকার আগে জমিতে মটরশুঁটি ছিটিয়ে দিলেই আর কিছু করতে হয়না। মটরশুঁটি আবাদে কোনো প্রকার পরিশ্রম বা বাড়তি খরচ নেই। এমনকি নিড়ানি বা সার, সেচ কিছুই লাগেনা। মটরশুঁটির ফল গ্রামের মহিলারা তুলে দেন এবং তাতে তারাও ভাল আয় করেন।
রুয়ের ভাগ গ্রামের কৃষক শুকুর আলী জানান, মটরশুঁটির শাক এবং সবজি হিসাবে মটরশুঁটির ফলের ব্যাপক চাহিদা বাজারে। অন্যদিকে গোখাদ্য হিসাবে মটরশুঁটির লতাজাতীয় এই গাছের ভাল কদর এবং দাম পাওয়া যায়। যখন অন্য কোনো ফসল করে খরচের টাকাই ওঠে না তখন মটরশুঁটি নাটোরের কৃষকদের কাছে এক আশীর্বাদ বলে মন্তব্য করেন শুকুর আলী।
বেলাল, কালাম ও শুকুর আলীর মতই নাটোরের অসংখ্য কৃষকের কাছে মটরশুঁটি আবাদ এখন বিরাট সুযোগ বলে মনে করছেন কৃষক এবং সংশ্লিষ্ট কৃষিবিভাগের লোকজন।
চন্দ্রকলা গ্রামের মলেজান বেগম (৬৮) বলেন, 'মটরশুঁটির ফল তুলে কমপক্ষে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হয়েছে। ফলে বাচ্চাদের এবং নিজেদের খরচের জন্য কারো কাছে হাত পাততে হয়না। এতে সংসারে আমাদের মর্যাদা এবং সচ্ছলতা দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার মত হাজারো গরীব নারীর জন্য নাটোর অঞ্চলে মটরশুঁটির আবাদ একটা বিরাট সুযোগ তৈরি করেছে।'
জাহেদা বেগম নামে আরেক নারী বলেন, 'আগে সংসারের কাজ শেষ করে অলসভাবে বসে থাকতাম। এখন মৌসুমে মটরশুঁটি তুলে প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা আয় করি। আমার মতো অসংখ্য নারী শ্রমিক এই সময়ে একই রকম আয় করেন।'
নাটোরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মাহমুদুল ফারুক বলেন, 'এ বছর নাটোর জেলায় ১ হাজার ১৪ হেক্টর জমিতে মটরশুঁটি চাষ হয়েছে। গত বছর ছিল ১ হাজার ৪৫ হেক্টর। ডাল জাতীয় ফসল মটরশুঁটির আবাদ করলে জমির উর্বরতা বাড়ে। অন্যদিকে মটরশুঁটি মানুষের জন্য খুব পুষ্টিকর খাদ্য। মটরশুঁটি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে এই সবজি দারুণ কাজ করে ও শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। পাশাপাশি লতাজাতীয় এই মটরশুঁটির কাণ্ড গো-খাদ্য হিসেবে খুবই পুষ্টিকর।'
Comments