প্রতিকূল আবহাওয়াতে পেঁয়াজবীজ নিয়ে শঙ্কায় কৃষক
প্রতিকূল আবহাওয়া, পোকার উপদ্রব এবং মৌমাছি পরাগায়নের কম হওয়ার কারণে ফরিদপুরের পেঁয়াজবীজ চাষিরা এ বছর তাদের প্রত্যাশিত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবেন কী না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
বেশিরভাগ পেঁয়াজবীজ উৎপাদকের দাবি, চাষের সময় ঘূর্ণিঝড় 'জাওয়াদের' প্রভাবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে পেঁয়াজের বাল্ব বা কন্দ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
কৃষকরা তখন তাজা বাল্ব রোপণ করেছিলেন। তবে ফসল কাটার ঠিক আগে তীব্র গরম পড়ায় বীজগুলো পুড়ে যায়।
ফরিদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুরের নয়টি উপজেলার মোট ১ হাজার ৭১৪ হেক্টর জমি এ বছর পেঁয়াজের বীজ চাষে ব্যবহার করা হয়েছে, যা গত বছর ছিল ১ হাজার ৭১১ হেক্টর।
জেলার কৃষকরা রাজশাহী তাহিরপুর, সুপার কিং, সুখসাগর, বারী-৪, নাসিক কিং এবং কিছু হাইব্রিডসহ বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজের বীজ চাষ করেছেন। 'গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ' নামে একটি নতুন জাতের পেঁয়াজবীজও এ বছর রোপন করা হয়।
ফরিদপুর সদর উপজেলার অন্তর্গত ভাসানচর, পূর্ব ভাসানচর ও ধুলদি গোবিন্দপুর গ্রামের কয়েকটি খামার সরেজমিনে পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখা যায়, পেঁয়াজের বীজের বেশিরভাগ কাণ্ড শুকিয়ে গেছে এবং পরাগায়নের অভাবে ফুল ফোটেনি। এছাড়াও তিনি কাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কিছু বাল্ব পড়ে থাকতে দেখেন, যেগুলো শুঁয়ো পোকার খাবারে পরিণত হয়েছে।
গোবিন্দপুর গ্রামের পেঁয়াজবীজ চাষি আলমাস মণ্ডল বলেন, 'এ বছর সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে ২ একর জমিতে পেঁয়াজের বীজ চাষ করেছি।'
'ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চাষের সময় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে সব বাল্ব নষ্ট হয়ে যায়। তাই ওই মাসের শেষ সপ্তাহে আবার রোপণ করি,' যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু গরমে বেশিরভাগ ফুল শুকিয়ে গেছে, এখন আমি এ বছর ৫০ কেজি বীজও পাবো কি না জানি না।'
ভাসানচর গ্রামের কৃষক আবুল হাসান তুহিন জানান, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যবর্তী সময় পেঁয়াজের বীজ চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। তারপর মার্চের শেষ সপ্তাহ এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ফসল কাটার জন্য প্রস্তুত হয়।
কিন্তু ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমার জমিতে বৃষ্টির পানি আটকে যাওয়ায় আমাকে পেঁয়াজের বীজ চাষ করতে হয়েছিল। আমি এ বছর মাত্র এক একর জমিতে চাষ করেছি এবং আশা করছি মাত্র ১২০ কেজি বীজ পাব, বলেন তিনি।
একই এলাকার আরেক পেঁয়াজবীজ উৎপাদক জলিল জমাদার জানান, প্রায় ২০০ কেজি বীজ পেতে গত বছর ২ লাখ টাকা খরচ করে ২ একর জমিতে ফসল চাষ করেছিলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'বীজ থেকে আমি ১ লাখ টাকা লাভ পেয়েছিলাম। তাই এ বছর সাড়ে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে আড়াই একর জমিতে চাষ করেছি। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে ৫০ কেজির বেশি বীজ পাব না।'
ফরিদপুরের অন্যতম বড় পেঁয়াজবীজ উৎপাদক শাহিদা বেগম জানান, প্রায় ৭৪ হাজার কেজি বীজ পাওয়ার জন্য গত বছর ৩৫ একর জমিতে ফসল চাষ করেছিলেন তিনি।
তিনি প্রতি মণ (৩৭ কেজি) বীজ ৭০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে বিক্রি করেছিলেন। তবে এই বছর তিনি মাত্র ৩০ একর জমিতে চাষ করেছেন, কারণ প্রাথমিক চাষের সময়কালে বৃষ্টি পেঁয়াজের বাল্বের ক্ষতি করেছিল।
এ বছর খরা, পোকামাকড়ের উপদ্রব এবং পরাগায়নের অভাবে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন আগের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের চেয়ে বেশি হবে বলে আশা করা যাচ্ছে না।
তবুও, তিনি আশা করেছিলেন যে পেঁয়াজের বীজের দাম গত বছরের তুলনায় বেশি হবে এবং এতে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
তিনি বলেন, 'এ বছর নতুন জাতের পেঁয়াজের বীজ চাষ করেছি। এর নাম গ্রীষ্মকালের পেঁয়াজ এবং এটি সারা বছর চাষ করা যায়', যোগ করেন তিনি।
ফরিদপুর ডিএই'র উপ-পরিচালক হযরত আলী বলেন, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম এই জেলাতেই প্রথম পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করা হয়েছে।
গত বছর সারা ফরিদপুর জুড়ে ১ হাজার ৭১১ হেক্টর জমিতে মোট ৮৯০ টন পেঁয়াজবীজ উৎপাদন হয়েছিল।
'যদিও আমাদের লক্ষ্য ছিল এই বছর ৮৫০ টন উৎপাদন নিশ্চিত করা, তবে এটি ৫০০ টনের বেশি হবে না', যোগ করেন হযরত আলী।
তিনি আরও বলেন, 'গত বছর প্রতি দশক জমিতে প্রায় ১ থেকে ১ দশমিক ২৫ কিলোগ্রাম পেঁয়াজের বীজ উৎপাদিত হয়েছিল, কিন্তু এ বছর একই পরিমাণ জমি থেকে মাত্র ৫০০ গ্রাম বীজ পেতেও বেগ পেতে হয়েছে।'
Comments