কেউ শোনেনি তার মিনতি, বুকে চাপা কষ্ট

গৌরাঙ্গ সাহা রায়। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের বাঙালি অভিবাসীরাও আনন্দে মেতেছেন এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনাগুলোর স্মৃতি মনে করছেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের বাঙালিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

তারা বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংসতার ঘটনাগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরেন, ব্রিটিশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তদবির করেন এবং শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন। যুক্তরাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙ্গালিরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিতে অ্যাকশন কমিটি গঠন করে।

যুক্তরাজ্যের বাঙালি অভিবাসীদের দারি ও লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে বারবার অনুরোধ জানানো স্বত্বতেও এখনও মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ ও বাঙালিদের অবদানের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে নথিবদ্ধ করেনি।

তবে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে বাঙালি অভিবাসীদের অবদানের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করার। তাদের মধ্যে অন্যতম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত ও প্রখ্যাত লেখক আব্দুল মতিন, ইতিহাসবিদ ইউসুফ চৌধুরী, স্বাধীনতা ট্রাস্ট, সেন্ট্রাল লন্ডন ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট, ইতিহাসবিদ ফারুক আহমেদ, স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আবদুল মান্নান, চ্যানেল এস এবং দ্য বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি।

গত ২০ জুন দৈনিক সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে ১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্দোলনকারীকে ১২ জনকে তাদের বিশেষ অবদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দেওয়া হবে এবং এ সংক্রান্ত সকল সুবিধা তারা পাবেন। এমন সিদ্ধান্তে সে সময় যুক্তরাজ্যে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন এমন অনেকেই বিস্মিত ও অপমানিত হয়েছেন। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বেশ কিছু বৈঠক করেছেন আন্দোলনকারীরা।

১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন বিতর্কের উর্ব্ধে ছিল না। বলা হয়, যুক্তরাজ্যে বাঙালিদের সংগ্রহকৃত তহবিলের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার যোগান আসে। ফারুক আহমেদের লেখা 'বেঙ্গল পলিটিক্স ইন ব্রিটেন' বইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য থেকে সর্বমোট চার লাখ ১২ হাজার ৮৩ ব্রিটিশ পাউন্ড সংগ্রহ করা হয়েছিল, যার মধ্যে তিন লাখ ৭৮ হাজার ৮৭১ পাউন্ড বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

সে সময় তহবিল তছরুপের অভিযোগ আসে। কিন্তু অভিযোগের তদন্ত করে ডাইরেক্টর অব পাবলিক প্রসিকিউশান এবং ব্রিটিশ বোর্ড অব ট্রেড সেই অভিযোগ নাকচ করে দেয়।

তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, লন্ডন অ্যাকশন কমিটির এক সদস্য এই মিথ্যা দাবির কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হন। তিনি গৌরাঙ্গ সাহা রায়।

তিনি নিজেই তার অবদানের বর্ণনা দেন, 'যখন মুক্তিযোদ্ধারা দেশে শত্রুর মোকাবিলা করছে, তখন এখানে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সংহতি জিতে নেওয়া। এর জন্য আমরা লন্ডন ও অন্যান্য শহরের পথে নেমেছি, মিছিল করেছি, সংসদ সদস্যদের কাছে তদবির করেছি এবং বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস, বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রেড ইউনিয়ন, গণমাধ্যম ও অন্যান্য প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানে গেছি। আমরা সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রকাশনার মাধ্যমে আমাদের দাবির স্বপক্ষে জনমত তৈরি করেছি। আমরা যুদ্ধের পুরো ১০টি মাস জুড়ে এই প্রচারণামূলক কৌশল বজায় রেখেছি। সবশেষে আমরা সফল হয়েছি এবং আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। আমি স্বাধীনতা অর্জনের এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে বিশেষভাবে গর্ব বোধ করি।'

তবে যুদ্ধ শেষে গৌরাঙ্গ সাহা রায় জানতে পারেন, লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন ভুলক্রমে যুদ্ধপরবর্তী নিরীক্ষণ প্রতিবেদনে তাকে সংগৃহীত তহবিলের পুরো অংশ জমা দেয়নি এমন একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

গৌরাঙ্গ সাহা তার কাছে থাকা ছয়টি রশিদ বই লন্ডন অ্যাকশন কমিটির কাছে ফেরত দেন। সঙ্গে কাউন্টারফয়েল এবং সকল সংগৃহীত অর্থও বুঝিয়ে দেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, লন্ডন অ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে গৌরাঙ্গ সাহার কাছ থেকে সংগৃহীত পাঁচটি রশিদ বই জমা দেয়। অপর বইটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি লন্ডন ও একটি বাংলাদেশভিত্তিক সংবাদপত্র এই ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। বিস্ময়করভাবে, ৩২ জনের বিরুদ্ধে রশিদ বই হারানোর অভিযোগ থাকা স্বত্বতেও, পত্রিকাগুলো তাদের প্রতিবেদনে শুধুমাত্র গৌরাঙ্গ সাহার ঘটনাটির বর্ণনা দেয়। তারা তালিকায় থাকা অন্যদের নাম কিংবা বাকি হারিয়ে যাওয়া রশিদ বইগুলোর ব্যাপারে কিছুই প্রকাশ করেনি। অভিযোগ আছে, তাদের মধ্যে একজনের কাছ থেকেই ১৭টি বই হারিয়েছে এবং একটি কমিটি মোট ২৭টি বই হারিয়েছে। কিন্তু তাদের কারও কথা সেই প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়নি। সব মিলিয়ে ১৫৩টি রশিদ বইয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এ ঘটনা জানতে পেরে গৌরাঙ্গ সাহা তাৎক্ষনিক ভাবে বিষয়টি বাংলাদেশ হাইকমিশন ও লন্ডন অ্যাকশন কমিটির সভাপতি গাউস খানের কাছে উত্থাপন করেন। তারা স্বীকার করেন, তিনি নিশ্চিতভাবেই প্রতিবেদনে 'হারানো' বলে উল্লেখ করা রশিদ বইটি জমা দিয়েছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে তাকে দুটি সই করা চিঠি দেওয়া হয়। একটি দেন হাইকমিশনের অডিট ও অ্যাকাউন্টসের পরিচালক এমএএল মতিন এবং অপরটি দেন গাউস খান। তবে, হাইকমিশন হারিয়ে যাওয়া রশিদ বইটি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত ৩২ জনের তালিকা থেকে তার নামটি বাদ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। লন্ডন অ্যাকশন কমিটি সেই বইটি ফিরিয়ে দিতে পারেনি। যুক্তরাজ্যের ডিরেক্টর অব পাবলিক প্রসিকিউশান ও দ্য ব্রিটিশ বোর্ড অব ট্রেড তদন্ত করে নিশ্চিত করে, অডিট প্রতিবেদনে উল্লিখিত তহবিল তছরুপের অভিযোগটি ভিত্তিহীন এবং এক্ষেত্রে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই নিশ্চয়তার ভিত্তিতে হাইকমিশনের উচিৎ ছিল তাদের নথিতে ভুলটি শুধরে নেওয়া, কিন্তু তারা তা করেনি। ফলশ্রুতিতে, গৌরাঙ্গ সাহার নামটি অভিযুক্ত তহবিল তছরুপকারীদের তালিকায় থেকে যায়।

তিনি হাইকমিশনের সঙ্গে আরও দুবছর যোগাযোগ চালিয়ে যান। কিন্তু নিজের নামটি অভিযুক্তদের তালিকা থেকে বাদ দিতে ব্যর্থ হন। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ২২ আগস্ট তিনি শেষবারের মতো হাইকমিশনারকে একটি চিঠি দিয়ে নিজের নামটি তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানান। সেই চিঠির কোনো উত্তর তিনি পাননি। এরপর তার চাকরি ও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে তিনি লন্ডন ছেড়ে যান এবং এরপর তিনি এই প্রায় অসম্ভব কাজটি নিয়ে আর কিছু করার চেষ্টা করেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন জানান, তিনি বিষয়টির বিস্তারিত মনে করতে পারছেন না। তবে তিনি মনে করেন, গৌরাঙ্গ সাহা রায়ের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের এ ধরণের তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া উচিৎ নয়।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা একটা পুরনো বিষয়। তবে বিষয়টি নিয়ে লিখিতভাবে জানানো হলে আমরা খতিয়ে দেখবো।'

যোগাযোগ করা হলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, এই বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। তিনি বলেন, 'যদি তিনি (গৌরাঙ্গ) অভিযোগ দায়ের করেন, তাহলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।'

৮০ বছর বয়সী গৌরাঙ্গ সাহা রায়ের ওই সময়ের কথা মনে পরলে আহত বোধ করেন।

১৯৭১ সালে তার পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান। রাতের আঁধারে তার মা-বাবা, স্ত্রী, ছোট বোনেরা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে ভারত সীমান্তের কাছে একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন।

বর্তমানে তিন ছেলে, ছেলেদের বউ এবং চার নাতিনাতনি নিয়ে যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন তিনি। এই ভুল সংশোধন করা না হলে গৌরাঙ্গ সাহা রায়ের গায়ে লাগা কলঙ্কের ভুক্তভোগী হতে পারে তার পরের প্রজন্মও। একটি প্রশাসনিক ভুলের কারণে তার নাম চলে আসে একটি তালিকায়, কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও তিনি নিজেকে মিথ্যে দায় থেকে মুক্ত করতে পারেননি।

স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে তার নাম এই তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ১৯৭১ সালে মাতৃভূমির প্রতি তার অবদানের জন্য স্বীকৃতি জানানোর এখনই উপযুক্ত সময়।

 

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Yunus in Rome to attend Pope Francis’ funeral

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus reached Rome yesterday to attend the funeral of Pope Francis.

1h ago