চা শ্রমিকদের জন্য চিঠি কেন ইংরেজিতে

চা শ্রমিকদের বেশিরভাগই কোনো দিন বিদ্যালয়ে যাননি। অথচ দেশের অনেক চা শ্রমিক বাধ্য হন তাদের নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে ইংরেজিতে দাপ্তরিক যোগাযোগ বজায় রাখতে।

শুনতে উদ্ভট মনে হলেও দশকের পর দশক ধরে বেশিরভাগ চা বাগানে এটাই হচ্ছে।

দেশের ১৬৬টি চা বাগানে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। বাংলাদেশ চা শিল্প ২০১৯ এর পরিসংখ্যানগত হ্যান্ডবুক অনুসারে তাদের বেশিরভাগই মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সিলেটে।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন মৌলভীবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস বলেন, 'এই চা বাগানগুলো বেশিরভাগই ঔপনিবেশিক আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন নিয়োগকর্তারা ব্রিটিশ হওয়ায় তারা ইংরেজিতে যোগাযোগ করতেন। কিন্তু তারা চলে যাওয়ার ৭৫ বছর এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পরেও এখনও সেই ইংরেজির চল রয়ে গেছে।'

তিনি বলেন, 'চা বাগান কর্তৃপক্ষ যখনই শ্রমিকদের কোনো দাপ্তরিক চিঠি, আদেশ বা নির্দেশ দেয় তখন তা ইংরেজিতেই লেখা হয়। কিন্তু প্রায় সব শ্রমিক ভাষাটির সঙ্গে অপরিচিত হওয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হয়। অন্যান্য খাতে শ্রমিকদের তো বাংলায় চিঠিপত্র দেওয়া হয়। তাহলে এখানে কেন বাংলা নয়?'

কানিহাটি চা বাগানের চা শ্রমিক নেতা ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সীতারাম বিন বলেন, 'কিছু চা শ্রমিক নাম লিখতে শিখেছে। বেশির ভাগ শ্রমিকই টিপসই দিয়ে তাদের কাজ করেন। বর্তমানে চা শ্রমিকদের কিছু ছেলে-মেয়ে কিছুটা শিক্ষিত হয়েছে, কিন্তু চা শ্রমিকরা ইংরেজিতে দেওয়া চিঠি বোঝার বা উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। এ কারণে অনেকে বিপাকে পড়ছেন।'

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি পঙ্কজ কন্দ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইংরেজি চার্জশিট, টার্মিনেশন লেটার, ডিসচার্জ ও চুক্তির কারণে চা শ্রমিকরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।'

'অধিকাংশ চা শ্রমিকই শতবর্ষ ধরে চা বাগানে টিপসই দিয়ে কাজ করে আসছেন। একইভাবে তাদের নামের বিভিন্ন চিঠিপত্র ইংরেজিতে আসে। এসব চিঠি পেয়ে শ্রমিকরা দুশ্চিন্তায় পড়েন এবং আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। আমরাও ইংরেজিতে অনেক উত্তর দিয়েছি। কিন্তু কিছু ইংরেজির ব্যবহারে উত্তর দিতে জটিলতায় পড়তে হয়। শেষে উপায় না পেয়ে এখন বাংলায় উত্তর দিচ্ছি,' যোগ করেন তিনি।

চা শ্রমিকদের জন্য বাংলা বোঝা সহজ। বাংলাদেশের ১৬৬টি চা বাগানের মধ্যে অধিকাংশ চা কোম্পানি এখনো ইংরেজিতে চিঠি লেখে।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, 'এসব ইংরেজি চিঠি কোম্পানি বা শ্রমিকদের গোপনীয়তা নষ্ট করে। যখন কেউ একটি চিঠি পায়, যাতে ব্যক্তিগত কিছু উল্লেখ করা হয়, যেমন বরখাস্ত করা বা মজুরি নিয়ে আলোচনা, তথ্যটি সবার কাছে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ উত্তর দেওয়ার জন্য এসব চা শ্রমিকরা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে দেখা করে উত্তর তৈরি করাতে যায়।'

চিঠিগুলো বাংলায় দেওয়া হলে অন্তত শ্রমিকদের পরিবারের কেউ তা পড়ে বোঝাতে পারবে বলে যোগ করেন তিনি।

জানতে চাইলে চা বাগান মালিকদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেট চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, 'অনেকেতো বাংলায় দিচ্ছেন। যারা দিচ্ছেন না সেটা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিবো।'

ফিলিপ গাইন সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের গবেষক ও পরিচালক। তিনি ১৯৯৭ সাল থেকে চা শ্রমিকদের অধিকার ইস্যুতে রিপোর্টিং, মতামত, লেখালেখি ও চিত্রগ্রহণ করে আসছেন। তিনি ইংরেজিতে এ ধরনের চিঠির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূল শ্রম আইন-২০০৬ বাংলায়। দেশের অন্যান্য সব শ্রমিককে বাংলায় চিঠি দেওয়া হয়। তাহলে চা শ্রমিকদের কেন ইংরেজিতে টার্মিনেশন ডিসচার্জ বা কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হয়?'

তিনি বলেন, 'ব্রিটিশ আমলে সব চা বাগানে ইংরেজিতে চিঠি দেওয়া হতো। বর্তমানে কিছু বাগান বাংলা ব্যবহার করে।'

কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের ডিআইজি মাহবুবুল হাসান বলেন, 'এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। যদি কেউ করে, আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।'

Comments

The Daily Star  | English
tax collection target for IMF loan

Talks with IMF: Consensus likely on exchange rate, revenue issues

The fourth tranche of the instalment was deferred due to disagreements and now talks are going on to release two tranches at once.

12h ago