‘তালেবানি সংস্কৃতি প্রতিহত না করলে বিপদ’

শাহরিয়ার কবির। স্টার ফাইল ছবি

তালেবানি সংস্কৃতির প্রভাব প্রতিহত না করলে বাংলাদেশের অবস্থাও একদিন আফগানিস্তানের মতো হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

আজ বুধবার বিকেল ৩টায় 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াড আয়োজিত 'মৌলবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন' শীর্ষক ওয়েবিনারে তিনি এসব কথা বলেন।

শাহরিয়ার কবির বলেন, 'ইসলামের দোহাই দিয়ে যে মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাজনৈতিক গোষ্ঠী '৭১-এর গণহত্যা ও নারী ধর্ষণকে বৈধতা দিয়েছিল, তারাই ৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণ ও পাকিস্তানিকরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আবহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা বার বার তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তাদেরই রাজনৈতিক ও আদর্শিক উত্তরসূরি হচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের তালেবান, আল কায়েদা ও আইএস।'

'আফগানিস্তানের ২৫ বছর আগে আফগানিস্তানে তালেবানরা প্রথমবার ক্ষমতা দখল করে সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, চিত্রকলা চলচ্চিত্র সব কিছু নিষিদ্ধ করেছিল। নারীদের গৃহবন্দি করেছিল। অথচ এই আফগানিস্তানই জন্ম দিয়েছে হজরত জালালউদ্দিন রুমির মতো সঙ্গীত ও নৃত্যপ্রেমী সুফী সাধককে,' উল্লেখ করেন শাহরিয়ার কবির।

বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, 'জঙ্গী মৌলবাদীরা ওয়াজ ও সালানা জলসার নামে মাঠে ময়দানে যেমন, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত ও ভিন্ন জীবনধারায় মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচার করছে, সমাজে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করতে চাইছে, তালেবানদের মতো বিনোদনের সকল অভিব্যক্তি নিষিদ্ধ করতে চাইছে। সুযোগ পেলেই তারা সংস্কৃতিকর্মী, বিশেষভাবে বাউলদের ওপর হামলা করছে এই বলে যে, ইসলামে গান বাজনা হারাম।'

নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের সভাপতি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীতশিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, 'সংস্কৃতি প্রবহমান নদীর মতো। নদীতে বাঁধ দিলেও নদীর জল নিজেই তার গতি নির্ধারণ করে নেয়। সংস্কৃতি চর্চাও তেমনি। পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিলো কিন্তু সংস্কৃতিকর্মীরা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, ঠিক এমনিভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিলো কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতারের সংস্কৃতি কর্মীরা এই অপপ্রচারের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন।'

লালন সঙ্গীত শিল্পী ফরিদা পারভীন বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি বাউলদের চুল কেটে দেওয়া হয়েছে। এটি কেন হবে? আমাদের বাঙালির সংস্কৃতি তো এরকম হিংস্র না। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি একটি মানবিক সংস্কৃতি। ফকির লালন শাহ মানবধর্মকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তার দর্শন জাত-পাতের ঊর্ধ্বে মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য কোনো সংস্কৃতির বিরোধ থাকার কথা না। তবুও যদি মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়, তবে তা আমাদের প্রতিহত করতে হবে।'

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীতশিল্পী বুলবুল মহলানবীশ বলেন, 'বাঙালি কখনোই সাম্প্রদায়িক ছিল না তারা কী করে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে? সংখ্যালঘু বলে যারা চিহ্নিত, তাদের ওপর হামলা, ঘরবাড়ি দখল, লুটতরাজ, জোর করে ধর্মান্তরিত করা সবই মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থী।'

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি সঙ্গীতশিল্পী মাহমুদ সেলিম বলেন, 'সাংস্কৃতিক কার্যক্রম মানুষকে শিক্ষিত করে, সচেতন করে, নতুন করে ভাবতে শেখায় এবং তাই মৌলবাদী অন্ধত্বের বিনাশ ঘটায়। সে জন্যে জঙ্গি-মৌলবাদীদের প্রধান লক্ষ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম।'

আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান বলেন, 'সংস্কৃতি কোনো আলটপকা বিষয় নয় বরং এটি সামজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তি মানুষের মনভূমির ভিত্তি। ফলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও কোনো বিচ্ছিন্ন আন্দোলন নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের বুনিয়াদি বিষয়।'

নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতশিল্পী জান্নাত-ই-ফেরদৌসী বলেন, 'বস্তুত এই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ আমরা যৌথভাবে এক সুমহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। এই ঐতিহ্য বিভিন্ন যুগে নানক, কবীর, চৈতন্য ও ফকির লালন শাহ্-এর মতো মরমী সাধক এবং সর্বোপরি দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, কাজী নজরুলের মতো মহান কবির অনবদ্য অবদানের ফলে গড়ে উঠেছে।'

এই সমন্বয়ধর্মী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন, সংরক্ষণ ও লালন করার এবং সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব এই দক্ষিণ এশিয়ার সকল মানুষের। এই মনোভাব সকলের মাঝে জাগ্রত করতে হবে। সেই সাথে আমরা মনে করি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে পারলে মানবতাবাদী সমাজ গঠন সম্ভব।'

আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কোয়ালিশনের সংগঠক সাংবাদিক আসাদুল্লাহ সরকার বলেন, 'সংস্কৃতি হলো জাতির ধ্রুবতারা। এখানে মৌলবাদের কোনো স্থান নেই। মৌলবাদ সমাজের মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে তোলে। অপরদিকে জাতিকে তার সংস্কৃতি আলোর পথে পরিচালিত করে।'

জাগরণের গানের সংগঠক সঙ্গীতশিল্পী অরিত্র রতন বলেন, 'মৌলবাদের আগ্রাসন রুখতে হলে অংশগ্রহণমূলক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে।'

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য সংস্কৃতিকর্মী রেমন্ড আরেং বলেন, 'ইদানিং মৌলবাদ আমাদের সমাজের সকল পর্যায়ে শক্ত আসন গেড়ে বসছে। মৌলবাদ পরিশীলিত, সৃষ্টিশীল ও মানবিক সমাজ গঠনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।'

গণসঙ্গীত শিল্পী আরিফ রহমান বলেন, '৭৫-এর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর মানুষ আবার জেগেছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বিপ্লবী আহ্বানে। সোচ্চার হয়েছিল সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। সেই ধারাবাহিকতায় 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র সংগ্রামী সহযোদ্ধারা এখনো লড়াই করে চলেছেন।'

তুরস্কের 'টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিজম'-এর সাধারণ সম্পাদক লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি বলেন, 'পৃথিবীব্যাপী মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীরা যখনই ক্ষমতা গ্রহণ করে অথবা তৎপর হয়, সবার প্রথমে তারা আঘাত করে একটি দেশ অথবা অঞ্চলের সংস্কৃতিকে।'

নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের সদস্য সংস্কৃতিকর্মী পিন্টু সাহা বলেন, 'ধর্মীয় মৌলবাদ, বিশেষ করে ইসলামিক উগ্রবাদ এখন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে এ সমস্যার শেকড় ধীরে ধীরে গভীরতর হচ্ছে।'

ইন্দো-বাংলাদেশ ফোরাম ফর সেক্যুলার হিউম্যানিজমের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ভারতের সঙ্গীতশিল্পী শিউলি ভট্টাচার্য বলেন, 'সুস্থ-সংস্কৃতিবান মানুষেরাই চিরকাল যেকোনো ধরনের মৌলবাদ, সেটা ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদ যাই হোক না কেন, সবকিছুর বিরুদ্ধেই তাদের সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছেন।'

Comments

The Daily Star  | English

Polls no later than June 2026

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus has said that next national polls will be held within June 2026.

3h ago