দ্য ডেইলি স্টার-আইপিডিসি ‘আনসাং উইমেন নেশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন ৭ নারী চেঞ্জমেকার

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মুমিনুল ইসলামের সঙ্গে ‘আনসাং উইমেন নেশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ড ২০২২- এর বিজয়ীরা। ছবি: স্টার

দ্য ডেইলি স্টার ও আইপিডিসি'র উদ্যোগে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রাখায় গতকাল 'আনসাং উইমেন নেশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ডস'-এর ষষ্ঠ সংস্করণে ৭ নারীকে সম্মানিত করা হয়।

রাজধানীর বসুন্ধরায় ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ পুরস্কার তুলে দেন।

এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ধর্ম ও সংস্কৃতির অজুহাতে অনেকেই নারীকে যে কোনো কিছু করা থেকে দমিয়ে রাখে। সমাজের সৃষ্ট এসব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।

তিনি বলেন, আমি এই পুরস্কার তাদের হাতে তুলে দিতে পেরেছি এটাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

সামাজিক বাধার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে নারীদের উত্সাহিত করতে ডেইলি স্টার এবং আইপিডিসিকে সারা দেশে এই উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান টিপু মুনশি।

তিনি বলেন, নারীরা পুরুষের চেয়ে কম সক্ষম নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে। সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণকারী নারীদের বড় সমর্থক আমাদের প্রধানমন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, কেন নারীদের পেছনে ফেলে রাখা হবে? এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চেতনাকে প্রজ্বলিত করতে হবে।

আইপিডিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম বলেন, পুরস্কারপ্রাপ্তরা এবং আরও অনেক অপরিচিত নারী যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা বাকিদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

এমনই একজন নারী জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া। তিনি জন্ম থেকে হাঁটতে, হাত নাড়াতে বা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন না। কিন্তু, তিনি সব প্রতিকূলতাকে জয় করে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। তিনি বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় ২৫ জন নারীকে নিয়োগ দিয়েছেন।

তার ফেসবুক পেজ 'রেইনবো'র মাধ্যমে হাতে কাজ করা শাড়ি, কুশন এবং বেডকভারের মতো পণ্য বিক্রি করেন। ১৮টিরও বেশি দেশের মানুষ তার পণ্যের ক্রেতা। তিনি প্রতি মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকা আয় করেন।

শুধু তাই নয়, বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্যও পড়াশোনা করছেন মহুয়া।

পুরস্কার নেওয়ার সময় মহুয়া বলেন, এই আয়োজন আমাদের মতো মানুষদের উত্সাহিত করবে এবং সমাজের সমর্থন পেলে তারা সফল হবে।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাগআচড়ার ১৮ বছর বয়সী আরেক পুরস্কারপ্রাপ্ত তামান্না আক্তার নুরা কোনো হাত ছাড়া এবং মাত্র একটি পা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু, এটি তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি পায়ের আঙ্গুল কলম ধরে পরীক্ষা দেন এবং এ বছর এইচএসসি এবং ২০১৯ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান। এখন তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় বসতে চান।

তিনি বলেন, পুরস্কারপ্রাপ্তরা এবং অন্যান্য অনেক অপরিচিত নারী যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা বাকিদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

বাংলাদেশে এখনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বোঝা হিসেবে দেখা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি এই ধারণা পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করতে চাই।

নুরা আরও বলেন, পরিবর্তিত মানসিকতা এবং সমর্থন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পদে পরিণত করতে পারে।

জান্নাতুল সরকার চম্পা তার বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর চাটমোহর বাজারে সংবাদপত্র বিক্রি শুরু করেন। তিনি একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য। কিন্তু, তার জীবিকার উৎসের জন্য তাকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়, তবুও তিনি হাল ছাড়েননি।

গত বছর তিনি পাবনার চাটমোহর উপজেলার পারশোডাঙ্গা ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হন।

তার মতোই, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার জমিলা বেগমও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পেশাভিত্তিক ধারণাকে দূর করে দেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, নারীরাও যে কোনো কাজ করতে পারেন।

তাকেসহ ২ সন্তানকে রেখে চলে যান জমিলার স্বামী। এরপর তিনি কসাইখানায় কাজ শুরু করেন। এই কাজ করে তার স্বামীর ২.৮২ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করেন এবং গ্রামে একটি বাড়ি তৈরি করেন।

চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাকিয়া সুলতানা নোভা (২১) ৫০০ জনেরও বেশি নারীকে স্কুটার চালানো শিখিয়েছেন। একইসঙ্গে কীভাবে চলাফেরা ও নিরাপত্তার নিজের নিয়ন্ত্রণ নিতে হয় তা শিখিয়েছেন।

প্রশিক্ষণ নিতে ইচ্ছুক নারীরা নোভার ফেসবুক পেজ 'রোডবুক বিডি'তে নিবন্ধন করতে পারে। এই পেজটি ২০১৯ সালে খোলা হয়েছিল।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন বীরাঙ্গনা শিলা গুহ।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নির্যাতনের কথা জানতে পেরে বাবা ও স্বামী দুজনই তাকে পরিবারে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু তিনি পরাজিত হননি।

২০১৮ সালে ফরিদপুরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ফ্রি স্কুল 'হাসিমুখ পাঠশালা' প্রতিষ্ঠা করেন তাহেতুল জান্নাত রেমি। স্কুলটি ৩০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানো হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে।

তাহেতুল জান্নাত ফরিদপুরের নারীদের আত্মরক্ষা এবং যৌন সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষার কৌশল প্রশিক্ষণ দেয়। তার অন্য একটি সংস্থা 'নন্দিতা সুরক্ষা'র শিশু যৌন নিপীড়ন নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে কাজ করে।

তিনি বলেন, ফরিদপুরের মতো শহরে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরু করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও আমি সফল হয়েছি কারণ আমার পরিবার আমাকে সমর্থন করেছিল।

তাহেতুল জান্নাতের পরিচয় তুলে ধরার সময় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, তাহেতুলের মতো কিছু মানুষ আছেন যারা মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করতে ভালোবাসেন।

অন্যান্য পুরষ্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন- ওয়াটার এইড বাংলাদেশের হাসিন জাহান, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সেঁজুতি সাহা, সাজগোজের সিনথিয়া শারমিন ইসলাম, মশাল মেন্টাল হেলথের মারিয়া মুমু, মনের বন্ধুর তাওহিদা শিরোপা এবং নিজেরা করির খুশি কবীর।

দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, সামাজিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা ভেঙে এই নারীরা এগিয়ে গেছেন।

তিনি বলেন, আপনি কি চিন্তা করতে পারেন একজন নারী কসাই মাংস বিক্রি করছেন? এটি আপনার কাছে একটি ছোট অর্জন বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি আসলে একটি বিপ্লব শুরু করেছেন। অন্য একজন নারী তার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে একটি অনলাইন দোকান চালান। আজ, যখন আপনি এই ইভেন্ট ভেনু ছেড়ে চলে যাবেন, তখন আপনিও সব বাঁধার দেয়াল ভেঙে ফেলতে উত্সাহিত হবেন।

থিয়েটার গ্রুপ প্রাচ্যনাট্য এই অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে। অনুষ্ঠানে পুরষ্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে ২ লাখ টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়।

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

5h ago