নান্দিউড়ার মৃৎশিল্প কি হারিয়ে যাবে?
মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার নান্দিউড়া গ্রামের বাসিন্দারা যুগ যুগ ধরে মাটির তৈরি জিনিস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বর্তমানে এ পেশা ছেড়েছেন অনেকে। এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এখানকার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।
পৌষ মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত দেশজুড়ে বিভিন্ন মেলায় মাটির জিনিস বিক্রি হয় বলে এই সময় ব্যস্ততা বাড়ে নান্দিউড়ার মৃৎশিল্পীদের। এই সময়টা বাদ দিলে বছরের অন্যান্য সময় মাটির জিনিস তেমন বিক্রি হয় না। ফলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন এখানকার মৃৎশিল্পীরা।
নান্দিউড়ার মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কুমোরেরা হাতের খেলায় কাদামাটিতে গড়ে তোলেন একেকটি মনোমুগ্ধকর অবয়ব। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থেকেই এই কারিগররা যুগের পর যুগ ধরে যুগিয়ে চলেছেন বাঙালির শিল্পের রসদ।
গ্রাম-বাংলার এই মৃৎশিল্পীদের হাত থেকে যেমন নিত্য ব্যবহারের হাড়ি-পাতিল আসে, তেমনি গড়ে ওঠে পুতুল, হাতি-ঘোড়ার মতো খেলনা, পূজার প্রতিমা ও ঘর সাজানোর নানা উপকরণ।
নান্দিউড়ার মৃৎশিল্পীরাও এমন মাটির তৈজসপত্রসহ নানা শখের জিনিস তৈরি করে থাকেন।
মৌলভীবাজারের বাসিন্দা, লেখক আকমল হোসেন নিপুর ভাষ্য, এক সময় সিলেট অঞ্চলে মৃৎশিল্পের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এখন সেদিন আর নেই। তবে এখনো বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবে মাটির পাত্র ও থালা কেনার প্রয়োজন পড়ে। বারুণী মেলা, বৈশাখী মেলা ও চড়ক মেলাসহ বিভিন্ন মেলায় মাটির তৈরি তৈজসপত্র কম-বেশি বিক্রি হয়।
সম্প্রতি নান্দিউড়ায় গেলে কথা হয় সেখানকার মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে। এখানকার বাসিন্দা মাধব পাল বলেন, 'আগে যেকোনো উৎসব বা মেলার আগে আমরা আগেভাগেই অর্ডার পেয়ে যেতাম। দেশজুড়ে রঙিন মাটির জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া হত। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। মাটির পাত্রের বদলে এসেছে অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের পণ্য। তাই আগের সেই চাহিদা আর নেই।'
এর পাশাপাশি এই শিল্পের জন্য মাটি ও জ্বালানির যোগানের ক্ষেত্রেও নানা সীমাবন্ধতার কথা জানান প্রবীণ হরেন্দ্র পাল। তিনি বলেন, 'এখন মাটি ও জ্বালানি কাঠ জোগাড় করার বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়েছে। সবকিছুর বাড়তি দাম। ব্যবসাও আগের মতো নেই। তাই অনেকেই আর এই পেশা চালিয়ে যেতে পারছেন না। আমিও জানি না কতদিন পারব?'
মাধব পাল ও হরেন্দ্র পালসহ এই পেশায় নিয়োজিত কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কাজের জন্য মাটি সংগ্রহের কাজটিই এখন সবচেয়ে কঠিন। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমেই মাটি সংগ্রহের কাজটি করা হয়।
তারা জানান, মাটি সংগ্রহের জন্য প্রথমে একটি জায়গা চিহ্নিত করে ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত গর্ত খোঁড়া হয়। এরপর ভেতরের মাটি নেওয়া হয়।
কুমোররা বলছেন, জমির মালিকদের এখন ২০-২৫ হাজার টাকা দিতে চাইলেও তারা জমিতে গর্ত খুঁড়তে দিতে রাজি হতে চান না। ১ মন কাঠ কিনতে লাগে অন্তত দেড়'শ টাকা। আগে এর কোনোটির জন্যই পয়সা খরচ করতে হতো না।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক হেনরি গ্লাসি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প ও এর শিল্পীদের সম্পর্কে বলেন, 'ব্যবহারিক মৃৎপাত্রের মূল নান্দনিক মাত্রা উদ্ভাসিত হয় তার সৃষ্টিকালেই। ভোজের রান্নার সময় রাঁধুনি বা দুর্বোধ্য বিষয়কে প্রাঞ্জল গদ্যে পরিণত করার সময় বিদ্বান যে রকম তৃপ্তি বোধ করেন, কুমোরও তার কাজের প্রক্রিয়ায় একই নিবিষ্টতার আনন্দ পান।'
তাই হয়তো নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখনো নান্দিউড়ার কিছু মৃৎশিল্পী তাদের পিতৃপুরুষের এই পেশা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কুমোরদের এই দুর্দশার বিষয়ে কথা হয় রাজনগরের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বাবলু সূত্রধরের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমি জানি এখানে কিছু কুমোর পরিবার আছে। যদিও এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে, তারপরেও তাদের কিঝু আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার সুযোগ আছে। দেখি তাদের কীভাবে সাহায্য করা যায়।'
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর বক্তব্য, 'সরকার যদি সত্যিই এই শিল্পকে বাঁচাতে চায়, তাহলে কুমোরদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি অবশ্যই এ বিষয়ে আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাগুলো নিতে হবে।'
Comments