ইভিএম আমরা নিজেরা কিন্তু পরীক্ষা করে দেখিনি: ড. কায়কোবাদ

বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে এখন নির্বাচনী হাওয়া। আওয়ামী লীগের তুলে দেওয়া ইভিএম ইস্যু নির্বাচন কমিশন লুফে নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ডাকে সাড়া দিয়ে ইভিএম দেখতে গিয়েছিলেন ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ড. জাফর ইকবালসহ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।

তারা বলেছেন, ইভিএমে ভোট কারচুপির সুযোগ নেই। কিসের ভিত্তিতে তারা এ কথা বললেন? প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. কায়কোবাদের মুখামুখি হয়েছিল দ্য ডেইলি স্টার।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনারা বলছেন ইভিএমে ভোট কারচুপির সুযোগ নেই। কীসের ভিত্তিতে এ কথা বলছেন?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ: এই ইভিএম আমাদের দেশে ডিজাইন করা এবং বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে তৈরি করা। প্রযুক্তির শিক্ষক হিসেবে বাংলাদেশের যেকোনো প্রযুক্তির বিষয়ে আমার আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আমাদের নির্বাচনে যেরকম সমস্যা হতে পারে তা বিবেচনায় নিয়েই এটি ডিজাইন করা হয়েছে।

মেশিনের প্রতিটি অংশ তারা দেখিয়েছে। এটি এমন কোনো কঠিন প্রোগ্রামিংয়ের বিষয় নয়। প্রত্যেকটি অংশ কাস্টমাইজড। এর কোনো অংশ অন্য আরেকটি দিয়ে পরিবর্তন করা যাবে না। আমরা আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিয়ে বুঝেছি, সত্যি যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে এটা খুব ভালো একটি মেশিন।

তবে বলে রাখা দরকার, ওই স্বল্প সময়ে ইভিএম আমরা নিজেরা কিন্তু পরীক্ষা করে দেখিনি। তারা মেশিন দেখিয়ে যা বলেছে এবং আমরা আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে ইভিএম সম্পর্কে কথা বলেছি। নির্বাচন কমিশন বা রাজনৈতিক দলগুলো এখন এটা পরীক্ষা করে দেখতে পারে যে, যা বলা হচ্ছে তা ঠিক কি না। মেশিনের কোনো ভুলত্রুটি ধরা পড়ে কি না। এটাকে কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ব্ল্যাকবক্স টেস্টিং, যা ব্যবহারকারীরা করতে পারেন এবং ইনপুটের বিপরীত কাঙ্ক্ষিত আউটপুট পাওয়া গেলে তার সঠিকতার ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারি। আবার বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হোয়াইট বক্স টেস্টিংও করতে পারি।

ডেইলি স্টার: কোথায় পরীক্ষা হতে পারে?

ড. কায়কোবাদ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আমাদের দেশের জনগণের আস্থা রয়েছে। আমাদের বড় বড় প্রকল্পের কারিগরি বিষয়গুলো এখানে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। সুতরাং এই যন্ত্রটিও সেখানে পরীক্ষা করা যেতে পারে।

ডেইলি স্টার: আপনারা নির্বাচন কমিশনে গেলেন এবং ইভিএম দেখে বললেন, ভোট কারচুপির সুযোগ নেই। বিগত ২টি জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, সে সম্পর্কে তো আমাদের ধারণা আছে। সেখানে এমন বক্তব্য দিয়ে নিজেরা কী বিতর্কের মধ্যে পড়ে গেলেন না? কারচুপিহীন সুষ্ঠু নির্বাচন কি ইভিএমের ওপর, নাকি যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন সেই নির্বাচন কমিশনারদের ওপর নির্ভর করে?

ড. কায়কোবাদ: নির্বাচনে কী হবে, কীভাবে হবে, ইভিএমে হবে না ব্যালটে হবে, সে বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমি শুধু ইভিএমের টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে কথা বলছি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য আমি নির্বাচন কমিশনে যাইনি। প্রযুক্তিবিদ হিসেবে আমাকে ডাকা হয়েছে। প্রযুক্তি নিয়েই শুধু কথা বলেছি। এই ইভিএম ম্যানুপুলেট করে ফল পরিবর্তন করা যাবে না, সেকথা বলেছি। নির্বাচন কমিশনের জন-আস্থা বা গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন কমিশনে যাইনি।

ডেইলি স্টার: গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা, ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ইভিএমে ভোটারের পরিচিতি বের করা হলো; বুথের ভেতরে একটি দলের লোকজন; তারা ভোটারকে বলে দিচ্ছেন কোন বাটনে চাপ দিতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই চাপ দিয়ে দিচ্ছিলেন। এটা যদি মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা হয়, তাহলে ইভিএমে কারচুপির সুযোগ নেই, ম্যানুপুলেট করা যায় না—এ জাতীয় বক্তব্য কোনো গুরুত্ব বহন করে?

ড. কায়কোবাদ: আপনার অভিজ্ঞতা আমি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করছি না। মাঠের চিত্র যদি এমন হয়, যদি বিশ্বাস না থাকে, আস্থা না থাকে, তবে ইভিএম কেন—কোনো কিছু দিয়েই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ইভিএম ওপেনের পর আরেকজন যদি বাটন চেপে ভোট দিয়ে দেয়, সেই দায় তো মেশিনের নয়। এটা তো নির্বাচন ব্যবস্থাপনার বিষয়। আমরা তো ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলছি না। সেটা ঠিক করবে নির্বাচন কমিশন। আমরা ইভিএম নিয়ে কথা বলছি।

ডেইলি স্টার: ইভিএম মেশিন যিনি বা যারা পরিচালনা করবেন, তাদের ওপরই তো নির্ভর করবে যে মেশিনটি কীভাবে পরিচালিত হবে?

ড. কায়কোবাদ: সব প্রোগ্রাম আগে করে দেওয়া থাকবে। একটি কেন্দ্রে কতজন ভোটার আছেন, ভোটারের তথ্য সেটিতে দেওয়া থাকবে। ভোটারের তথ্য বলেন, বায়োমেট্রিক বলেন, এগুলো সব সেখানে দেওয়া থাকবে। প্রিসাইডিং অফিসার কে, সব তথ্যই রাখা থাকবে। এখন ভোট শুরু হলো, মানে ৮টায় ভোট শুরু হবে, ৪টা বাজলে শেষ হবে। এগুলো কিন্তু প্রোগ্রাম করে দেওয়া থাকবে। এগুলো আগে-পরে করা যাবে না।

উদাহরণ হিসেবে ধরেন, আমরা ব্যাংকে যাই, ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলি। কম্পিউটার হিসাবে করে যা বলে আমরা কি ওই তথ্য অবিশ্বাস করি, করি না। আমরা মনে করি, কম্পিউটার ঠিক মতোই হিসাব করে। ফলে আমাদের কনফিডেন্স চলে এসেছে। শত শত বার গিয়েছি। আমাদের জরুরি প্রয়োজনে ওরা টাকা ঠিকই দিয়ে দেয়। বিদেশের সফটওয়্যার, যন্ত্রাংশ অনেক সময় সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করি। নিজেদের প্রযুক্তি দল-মত নির্বিশেষে ব্যবহার করে, যদি দুর্বলতা থাকে তা দূর করে এটাকে আরও সমৃদ্ধ করা যেতে পারে।

ডেইলি স্টার: কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, যে জায়গা থেকে কাস্টমাইজড করা হচ্ছে, যে জায়গা থেকে প্রোগ্রাম করা হচ্ছে, সে জায়গার ওপরেও আমাদের বিশ্বাস নেই। প্রোগ্রামিং করা হয়েছে, কী প্রোগ্রামিং করা হয়েছে? গত নির্বাচনে কয়েকটি আসনে ইভিএমে নির্বাচন হয়েছিল। প্রশ্ন সেগুলো নিয়েও ছিল। সেগুলো সম্পর্কে কী আপনারা তথ্য সংগ্রহ করেছেন?

ড. কায়কোবাদ: আনফরচুনেটলি সেগুলো নিয়ে আমি খুব বেশি জানি না। পত্র-পত্রিকা থেকে যা জেনেছি, অসংখ্য জায়গায় ইতোমধ্যে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। সিস্টেমেটিক ভুল হয়নি, খুব বেশি প্রশ্ন ওঠেনি, এটা আমার ধারণা। ধারণাটা ভুলও হতে পারে। ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকে ইভিএমকে আরও সমৃদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, কেউ যদি আঙ্গুলের ছাপ দিতে না পারেন, সে জায়গায় একটু ইম্প্রুভ করা হয়েছে। প্রতিটি ইনক্লুশনকেই আপনি প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে পারেন।

ডেইলি স্টার: ভোট ইভিএমে না ব্যালটে হলো সেটা বড় কথা নয়। নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা থাকল কি না, সেটি তো প্রধান বিষয়।

ড. কায়কোবাদ: এই সন্দেহ দূর করার উপায় হলো—আমরা মেশিনটি বার বার ডেমনস্ট্রেশন বা ব্যবহার করতে পারি। আমরা বার বার ভোট দিয়ে দেখতে পারি, আসলে এটা ঠিকমতো কাউন্ট করতে পারে কি না। প্রত্যেকটা মেশিনে আলাদা আলাদাভাবে প্রোগ্রাম করা সম্ভব না। সেই কাজটি করা যাবে না। একটা প্রোগ্রামই সব মেশিনে চলছে। প্রত্যেকটি সেন্টারের জন্য ডেটা ভিন্ন। আমার মনে হয় যে, সাংবাদিক হিসেবে আপনারা নির্বাচন কমিশনকে বলতে পারেন, আমরা মেশিনটি ব্যবহার করে দেখতে চাই, এটা ম্যালফাংশন করে কি না। আপনারা বারবার ভোট দিয়ে তারপর দেখেন এটা ঠিক কাজ করে কি না। অনেকবার যদি আমরা টেস্ট করি, তখন আমাদের হয়তো একটা কনফিডেন্স আসবে।

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

11h ago