‘নয়া জামা কাপড় হামার ভাগ্যে জোটে নাই’

ঈদের দিনে মুখে হাসি নেই তিস্তাপাড়ের কৃষকদের। অকাল বন্যা আর কয়েকদফা ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। ঈদে নতুন পোশাক কেনা হয়নি, কারো কারো বাড়িতে এমনকি সেমাই চিনিও জোটেনি।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর বুকে চর গোবর্ধানের বাসিন্দা কৃষক মোবারক আলী (৬৭)। সংসারে তার স্ত্রী হাসেনবানু বেগমসহ (৬৩) ও দুই ছেলের পরিবারের ১০ জন একসঙ্গে বসবাস করেন। তার ১২ বিঘা জমি রয়েছে। কৃষিকাজের উপর পরিবারটি নির্ভরশীল।
গেল বছর ঈদুল ফিতরে তাদের সংসারে আনন্দ থাকলে এবারের ঈদে তা ম্লান হয়ে গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, আজ মঙ্গলবার ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বিষন্ন হয়ে পড়েন কৃষক মোবারক আলী। চার নাতি ও দুই নাতনি নতুন পোশাকের জন্য কান্নাকাটি করছিল। ঈদের দিন নতুন পোশাক পরে শিশুরা আনন্দঘন পরিবেশে মাতামাতি করে ঈদ উৎসব উদযাপন করে। কিন্তু মোবারক আলীর নাতি-নাতনির ভাগ্যে তা জোটেনি।
মোবারক আলী কষ্টভরা কণ্ঠে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এ বছর ঋণ নিয়ে জমিতে ধান, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করেছিলেন তিনি। কিন্তু অকাল বন্যা আর কয়েকদফা ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কৃষিকাজ ছাড়া বাড়তি কোনো আয়ের উৎস নেই মোবারক আলী ও তার দুই ছেলের। ঈদে তিনি আর তার স্ত্রী নতুন জামা-কাপড় পাননি তাতে কোনো দুঃখ নেই কিন্তু সংসারে শিশুরা নতুন পোশাক থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তিনি ভেঙ্গে পড়েছেন।
তিনি বলেন, 'ঈদ আছে কিন্তু হামারগুলার ঈদ নাই। নয়া জামা কাপড় হামার ভাগ্যে জোটে নাই। ঈদের দিনোত ভালো খাবারও যোগবার পাং নাই। ঈদগাহ মাঠোত য্যায়া নামায কোনা পড়ি আসি বাড়ি থাকি বেড়ায় গ্যাইছোং।'
কৃষক মোবারক আলীর স্ত্রী হাসেনবানু বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের সংসার ইতোমধ্যে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাই ঈদ উপলক্ষে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি। পরিবারের শিশুদের বুঝিয়েছেন পরিস্থিতি ভালো হলে নতুন পোশাক কিনে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, 'এবছর হামার কপাল খারাপ। জমির ফসল নষ্ট হয়া গ্যাইছে। দেড় লাখ টাকার মতোন লোন নেওয়া হইছে। যদি বাঁচি থাকি পরের বছর হামরাগুলা ঈদের আনন্দ কইরমো।'
কৃষক মোবারক আলীর মতোই বিষন্নতায় ভেঙে পড়েছেন একই চরের কৃষক নবিয়ার রহমান (৬০), মোকসেদ আলীসহ (৫৬) চরের সব কৃষক।
নবিয়ার রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ঈদ উপলক্ষে তাদের ভাগ্যে সরকারি কোনো সহায়তা জোটেনি। নতুন পোশাক না দেওয়ার বেদনায় তিনি সংসারের ৭ জনের কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। ঈদ মানে খুশি হলেও তাদের জন্য কোনো খুশি নেই কিন্তু তাদের ঈদ কাটছে বিষন্নতা নিয়ে।
কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের ধরলা নদীর চর সারডোব এলাকার কৃষক নজর আলী (৫৮) দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, চরবাসীর জন্য কোনো ঈদ নাই। চরের কিছু মানুষ তাদের পরিবারের সবাইকে নতুন পোশাক দিয়েছেন, ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু অধিকাংশ চরবাসী ঈদকে সাধারণ একটি দিন হিসেবে পালন করছেন। কারো ঘরে খাবার নেই, কারো পরিবারে আছে নতুন পোশাক না পাওয়ার বেদনা আবার কোনো পরিবারে সেমাই চিনিও জোটেনি। এভাবে ঈদের দিনটি কাটছে চরবাসীর।
'অকাল বন্যা আর কয়েকদফায় কালবৈশাখী ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে ফসলহানী হওয়া হামারগুলার ঈদ মাটি হয়া গ্যাইছে। সংসারে কারো মুখোত হাসি নাই। শিশু বাচ্চারা মন খারাপ করি বসি আছে,' তিনি বলেন।
শুধু তিস্তা ও ধরলা নদীপাড়ের চিত্র এমনটি নয়। ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমারও গঙ্গাধর নদ-নদীর বুকে অসংখ্য চরের মানুষের মাঝে নেই ঈদ আনন্দ। ঈদের দিনটি কষ্টে কাটছে অধিকাংশ চরবাসীর। নতুন পোশাক না পাওয়ার বেদনা তাদের আছে। সেই সঙ্গে অনেকের ঘরে খাবারও নেই। চরের অনেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পরিবারের জন্য পোশাক ও খাবার কিনেছেন। তবে অধিকাংশ চরবাসীকে ঈদের দিনে পুরাতন জামা-কাপড় পরে থাকতে হচ্ছে।
Comments