বর্শা দিয়ে শাহাদতের বুকে আঘাত করেন আমির হামজা: প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান

নিজ বইয়ে ব্যবহৃত আমির হামজার ছবি

দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া মো. আমির হামজা ছিলেন ৪৪ বছর আগে সংঘটিত একটি খুনের মামলার আসামি। ১৯৭৮ সালে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার বরিশাট গ্রামে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ওই মামলার রায়ে আমির হামজাসহ ৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আফজাল মোল্লা। তার ভাই রেজাউল হক মোল্লা ওই হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি দ্য ডেইলি স্টারের কাছে সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

রেজাউলের বর্ণনা অনুসারে, সেদিন সকালে গবাদি পশুর দ্বারা ফসলের খেত নষ্ট হওয়াকে কেন্দ্র করে আমির হামজার সঙ্গে খুনের শিকার শাহাদত হোসেনের বাকবিতণ্ডা হয়। এ সময় আমির হামজা বর্শা দিয়ে শাহাদতের বুকে আঘাত করেন। আমির হামজার ভাই গোলাম রব্বানীও শাহাদতের পেটে ছুরি মারেন। এরপর স্থানীয়রা শাহাদতকে ঘটনানস্থল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি মারা যান।

গত ১৫ মার্চ সরকার এবারের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত ১০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করে। তাতে সাহিত্যে প্রয়াত আমির হামজার নাম আসে।

নাগরিক মহলে অচেনা আমির হামজার নাম দেখে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন। এর মধ্যেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে, ১৯৭৮ সালে একটি খুনের মামলার প্রধান আসামি ছিলেন আমির হামজা। বিচারিক আদালতের রায়ে ওই মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হলেও পরবর্তীতে 'রাজনৈতিক বিবেচনায়' সাধারণ ক্ষমা পান তিনি।

শাহাদত হোসেন খুন হওয়ার ঘটনায় তার আত্মীয় আমজাদ মোল্লার দায়ের করা মামলায় আমির হামজা ছিলেন এক নম্বর আসামি। মামলা দায়েরের প্রায় ৭ বছর পর রায়ে বিচারিক আদালত ৬ জন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। আমির হামজার পাশাপাশি সাজাপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা ছিলেন–আমির হামজার ভাই গোলাম রব্বানী সর্দার, নুরুল মোল্লা, হাসেম মোল্লা, ওমেদ চৌধুরী ও আফজাল মোল্লা।

আফজাল মোল্লার ভাই রেজাউলের ভাষ্য হলো, আমির হামজা ছিলেন বিএনপি নেতা। শাহাদত খুন হওয়ার দিনেই তিনি একই গ্রামের তেশেম শেখের বাড়িতে বর্শা নিয়ে হামলা করেন। এ সময় শিল্পিনা নামের আড়াই বছরের এক শিশু মারা যায়। সে ছিল ওই গ্রামের শাবান মোল্লার মেয়ে।

আমির হামজার হাতে নিহত শাহাদত হোসেনের ছেলে শহিদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাবার মৃত্যুর পর আমরা চরম সংকটের মধ্যে পড়ে যাই। ৪ ভাইয়ের সবাই ছিলাম নাবালক। সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। এ অবস্থায় আমাদের পক্ষে এক আত্মীয় বাদী হয়ে মামলা করেন।'

এই মামলায় দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আমির হামজা ও তার ভাই গোলাম রব্বানীসহ ৫ জনই মারা গেছেন। বেঁচে আছেন কেবল আফজাল মোল্লা (৮২)। গতকাল বৃহস্পতিবার বরিশাট গ্রামে তার বাড়িতে বসে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। শাহাদত হোসেন হত্যা মামলায় আমির হামজা ও তিনিসহ ৬ জনের দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি। জানান,  প্রায় ৯ বছর কারাভোগের পর ১৯৯১ সালে আমির হামজার সঙ্গে তিনিও কারাগার থেকে মুক্তি পান।

একই দিন নিহত শিশু শিল্পিনার বাবা শাবান মোল্লা ডেইলি স্টারকে জানান, ওই ঘটনার সময় তার মেয়ে নানাবাড়ি ছিল। নানীর কোলে থাকা অবস্থায় শিল্পিনার শরীরে বর্শা লাগে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তবে এই মামলায় আমির হামজাকে আসামি করা হয়েছিল কিনা, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।

বরিশাট গ্রামের আরও কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমির হামজা ব্যবসার পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।  তারা আরও জানান, অন্তত দুই মেয়াদে শ্রীকোল ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন আমির হামজা।

বাজারে 'বাঘের থাবা', 'পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি' ও 'একুশের পাঁচালি' নামে আমির হামজার ৩টি বইয়ের হদিস পাওয়া যায়।

এ ছাড়া জন্মস্থান মাগুরায় আমির হামজাকে 'চারণ কবি' হিসেবে চিনতেন অনেকে। তিনি গানের আসরে বসে গান লিখতেন, সুর করতেন।

আমির হামজার এক ছেলে আসাদুজ্জামান সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বর্তমানে খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন। ২০১৯ সালে মারা যাওয়া আমির হামজাকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা ছেলের তৎপরতার কথাও এসেছে সংবাদ মাধ্যমে।

'মিথ্যা' অভিযোগে আমির হামজার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল মন্তব্য করে তার বড় ছেলে আলী মর্তুজা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শাহাদত হত্যা মামলায় বাবা কিছুদিন কারাভোগ করেছিলেন। এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা গ্রামে গ্রামে প্রায়ই ঘটে।'

শাহাদত হত্যা মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শুকদেব রায় বলেন, 'এ ঘটনা বহু বছর আগের। এই মামলা সম্পর্কে আমি জানি না।'

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh Police: Equipped to inflict heavy casualties

Police arms records show the brutal truth behind the July killings; the force bought 7 times more lethal weapons than non-lethal ones in 2021-23

12h ago