‘বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে চাই’

তানিয়া। ছবি: স্টার

পাবনার বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া গ্রামের তানিয়া ইয়াসমিনের ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু, পরিবারের চাপে ২০১৫ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর তাকে এক প্রতিবেশীর সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়।

হাটুরিয়া গ্রামের বাহেজ উদ্দিনের মেয়ে তানিয়ার জীবনে কিছু করার তাগিদ সব সময়ই ছিল। অদম্য ইচ্ছা শক্তি দিয়েই এই কিশোরী কন্যা পরিবার-সমাজের নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এখন দেশসেরা সফল উদ্যোক্তার খেতাব পেয়েছেন।

বাল্য বিয়ে, গৃহ-নির্যাতন ও বিবাহ বিচ্ছেদসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত জীবনযুদ্ধে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তানিয়া এখন সংগ্রামী নারীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়েছেন।

তানিয়া ইয়াসমিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর যখন কলেজে ভর্তি হতে চাই তখনই আসে বিপত্তি। শ্বশুরবাড়িতে কেউ চায় না বাড়ির বউ কলেজে পড়ুক।'

অবশেষে শ্বশুরবাড়ির অমতেই মায়ের সহায়তায় কলেজে ভর্তি হন তানিয়া। শুরু হয় তার ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। গৃহ-নির্যাতন থেকে বাঁচতে প্রায়ই তাকে ফিরে আসতে হতো বাবার বাড়ি। এভাবে চলতে থাকে কয়েক বছর।

এক পর্যায়ে তিনি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। একই সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে অনার্সে ভর্তি হন।

বেকার স্বামী পরিবারের খরচ যোগাতে পারেন না, তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন তানিয়া। কাজ করেই তিনি লেখাপড়ার খরচ চালান। এক পর্যায়ে মায়ের অনুপ্রেরণায় কম্পিউটার শিখে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে উদ্যোক্তা হিসেবে তানিয়া কাজ শুরু করেন। সেটা ছিল ২০১৮ সাল। এরপর তার ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন।

ছবি: স্টার

তানিয়া আরও বলেন, 'ইউনিয়ন পরিষদে উদ্যোক্তার কাজ করে যে উপার্জন হয় তা দিয়ে কোনো মতে সন্তানের খরচ যোগান দিতে থাকি। এতেও স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাধা দেন। ইউনিয়ন পরিষদের কাজ ছাড়তে চাপ দেওয়া হয়। আমি কাজ ছাড়তে রাজি হয়নি।'

কোনভাবেই যখন কাজ থেকে বিরত রাখা যায়নি তখন তার স্বামী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করে তাকে হেয় করতে থাকেন বলে দাবি করেন তিনি।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বিচার চান তানিয়া। স্বামীর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে একপর্যায়ে তাকে বিবাহ বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে হয়।

তরুণ বয়সে ৩ বছরের সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন তানিয়া। এরপরও তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে হয়রানি করা হয়। এক পর্যায়ে তিনি বেড়া পৌরসভা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে সন্তানসহ থাকতে শুরু করেন।

সে সময় বেড়া শহরের ফকির প্লাজায় ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেট নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।

তানিয়া ভাষায়, 'মাত্র ৪ মাসেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ২ হাজারের বেশি হিসাব খোলা হয়েছে। ৪০টি ডিপিএস খোলা হয়েছে। প্রতিদিন লেনদেন হয় প্রায় ৪ লাখ টাকা।'

অসীম সাহসিকতা ও হার না মানা লড়াইয়ের মাধ্যমে সফল উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন বলে মনে করেন তিনি।

পাবনা জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা কানিজ আইরিন জাহান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তানিয়া সফল উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন। সফল উদ্যোক্তার খেতাব পেয়েছেন। এ ছাড়া, জেলা পর্যায়েও তাকে "জয়িতা" হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'জীবন সংগ্রামে লড়াই করে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তানিয়া এখন সংগ্রামী নারীদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।'

তানিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি সমাজের অবহেলিত নারীদের নিয়ে কাজ করে যেতে চাই। নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে, সর্বোপরি বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে চাই।'

Comments