‘আয় বাড়ে বড়লোকদের, আর গরিবদের খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়’

রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন রাজিয়া সুলতানা (ছদ্মনাম)। থাকেন নাখালপাড়ায়। ২ বছর আগেও তার খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংসসহ বিভিন্ন ফলমূল ঠাঁই পেত। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে বেতন না বাড়া ও তার বিপরীতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে খাদ্যতালিকা কাঁটছাট করতে হয়েছে রাজিয়ার।

রাজিয়া জানান, কয়েক বছর আগেও তিনি প্রায়ই দেশি মুরগির মাংস খেতেন। বিভিন্ন ধরনের বাদাম, নানা ধরনের ফলমূল, দই কিনতে পারতেন। এখন তিনি দেশি মুরগির পরিবর্তে ব্রয়লার মুরগি কেনেন। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় থাকে না ফলমূল। ৩ বেলা খাবার জোটানোটাই তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুধবার দুপুরে রাজিয়া সুলতানা টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে এসব কথা জানান।

রাজিয়া বলেন, 'প্রায় ৭ বছর ধরে আমার বেতন বাড়েনি। কিন্তু বাজারের সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমূখী। ফলে বাধ্য হয়ে খাবারের খরচ কমাতে হয়েছে। খাবারের তালিকায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। সবশেষ কবে দেশি মুরগি, সামুদ্রিক মাছ কিনেছি সেটা মনে নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'গত ৩ বছরে আমাকে আড়াই ভরি স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করতে হয়েছে। ২ বছর আমি কোনো ফল কিনিনি। পুরনো শাড়ি কেটে সালোয়ার কামিজ তৈরি করে পরি।'

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে আয় না বাড়ায় হিমশিম অবস্থা শুধু রাজধানীবাসীর নয়। ঢাকার বাইরে যারা আছেন, তাদেরও একই অবস্থা। দিনাজপুরের শহিদুল ইসলাম (৪৫) পেশায় ফেরিওয়ালা। করোনা মহামারি শুরুর আগে যা আয় হতো তা দিয়ে স্ত্রী সন্তানসহ ৪ সদস্যের পরিবার নিয়ে ভালোভাবেই চলতেন। এখন তার আয় কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। ৩ বেলা পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবার যোগান দেওয়াটাই তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শহিদুল টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী বিক্রি করি। করোনার আগে মানুষ ভালোই কিনতো। কিন্তু এখন আর খুব একটা কেনে না। অনেকে বলে টাকা নেই। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫টি গ্রাম ঘুরি। সবাই বলে টাকা নেই, কিছু নিতে পারব না।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১৬ বিলিয়ন ডলার এবং দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৯১ ডলার।

মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সেটা জানেন কি না জিজ্ঞেস করলে শহিদুল ইসলাম বলেন, 'যারা আয় বাড়ার কথা বলে, তারা একবার গ্রামে এসে দেখুক, মানুষ কত কষ্টে দিন পার করছে। আয় বাড়ে বড়লোকদের। আর আমাদের মতো গরিব মানুষদের খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়। আমাদের গরিব মানুষদের দেখার কেউ নেই।'

রাজিয়া সুলতানা মাথাপিছু আয় বাড়ার বিষয়ে বলেন, 'সরকার বলছে আয় বেড়েছে। তারা কীসের ভিত্তিতে এই কথা বলছে, তা বুঝতে পারছি না। আয় বাড়লে যারা বিত্তবান, শুধু তাদেরই বেড়েছে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহবুবুল মোকাদ্দেম (এম এম আকাশ) টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার আয় বাড়ার যে হিসাব দেয়, তা হলো গড় হিসাব। গড়ের মধ্যে সবসময় বণ্টনের ফাঁকি লুকিয়ে থাকে।'

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি সব জায়গায় বৈষম্য রয়েছে। দেশে গড় আয়, গড় শিক্ষা, গড় স্বাস্থ্যসেবা, গড় আয়ু অনেক বেশি। কিন্তু বাস্তবে গরীবদের ক্ষেত্রে সবগুলোই অনেক কম। তাদের সুযোগ-সুবিধা কম। তারা সবসময় বৈষম্যের শিকার।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গড় মাথাপিছু আয়ের কথা বলে শুভঙ্করের ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। যারা এই হিসাব দেন, জনগণের সঙ্গে তাদের তেমন সম্পৃক্ততা নেই। তারা গ্রামে থাকেন না। গরিব মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের হাতেই অর্থ। এটা একটা ভয়ংকর অবস্থা।'

তিনি বলেন, 'মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা বলে আমাদের ঘুমপাড়ানি গান শোনানো হয়। তারা বেগম পাড়ায় টাকা পাচারের আনন্দে আছেন। তারা বলবেই যে, দেশ উন্নত হচ্ছে। কারণ তাদের অর্থ সম্পদ বাড়ছে। দেশের অবস্থা তেমন একটা ভালো না।'

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গড় মাথাপিছু আয় দিয়ে সার্বিক চিত্র বোঝা যায় না। বিভিন্ন স্বাধীন গবেষণায় দেখা গেছে, অর্থনীতির সুফল সবার মধ্যে পৌঁছায় না। আয় বৈষম্য ও সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে। কেউ কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট বাড়ছে।'

তিনি বলেন, 'সবক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজ করছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ থেকে সরে এসেছি। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের যে ধারণা সেখান থেকে সরে গেছি। এ জন্যই বৈষম্য দূর হচ্ছে না। আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে ভাবছি। মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে ভাবছি না। আমাদের সংসদ এখন ব্যবসাবান্ধব, সামাজিক সুরক্ষাবান্ধব নয়। এটা বৈষম্য দূর না হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ বলে আমি মনে করি।'

Comments

The Daily Star  | English

Sagar-Runi murder: Inconclusive DNA test results stall probe

The task force investigating the 2012 murders of journalist couple Sagar Sarowar and Meherun Runi in its report submitted to the High Court last month said it required more time to complete the probe as the results of the DNA samples collected from the scene were inconclusive.

4h ago