মূল্যস্ফীতি ও ফরেক্স রিজার্ভে চাপ কমাতে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার
সরকার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে উদ্যোগ জোরদার করেছে।
এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে অত্যাবশ্যক নয় এমন পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং বাড়তে থাকা দৈনন্দিন খরচ থেকে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।
মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে সহায়তা দেওয়ার জন্য, পরিশোধিত সয়াবিন, পাম, সরিষা, ক্যানোলা ও জলপাই তেলের ওপর থেকে মূল্য সংযোজিত কর (ভ্যাট) প্রত্যাহার করা হবে বলে সূত্ররা জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে রাইস ব্র্যান ওয়েলের রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সরকার একইসঙ্গে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে এবং সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ও আধা-সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
উচ্চ পর্যায়ের আমদানি নির্ভর প্রকল্পগুলোকেও মুলতবি রাখা হচ্ছে।
প্রসাধনী, ফুল, ফল, আসবাবপত্র সহ প্রায় ১৩৫টি পণ্যের উপর ২০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গতকাল জানিয়েছে, এই শুল্কের হার আগে শূন্য থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে ছিল
অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি বর্ধিত শুল্ক দেশীয় শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে, মূল্যবান বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের সাশ্রয় করবে এবং রাজস্ব বাড়াবে বলে জানিয়েছে এনবিআর।
গত ১৯ মে এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল, যা ৫ মাসের আমদানি খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক ১ বিলিয়ন, যা একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল।
গত বছর থেকে কমতে থাকা রেমিট্যান্সের প্রবাহ ও রিবাউন্ডিং আমদানির কারণে রিজার্ভ চাপে মুখে পড়ে। পরবর্তীতে, রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমছে।
এ অর্থবছরের শুরুতে ডলারের আনুষ্ঠানিক বিনিময় মূল্য ৮৪ দশমিক ৮ টাকা থাকলেও এ মুহূর্তে তা ৮৭ দশমিক ৯ টাকা। তবে, খোলা বাজারে ডলার সংকটের কারণে বিনিময় মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকায়।
গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রীষ্মকালীন দেশীয় ফলের মৌসুমে আপেলের মতো বিদেশি ফলের আমদানির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বৈঠকে উপস্থিত এক সূত্রের বরাতে দ্য ডেইলি স্টার এ তথ্য জানতে পেরেছে।
পরবর্তীতে তিনি অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলারের চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার প্রক্রিয়া খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন।
গত ১৭ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মুখে মিতব্যয়ীতার চর্চা এবং খরচের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করার আহ্বান জানান।
ইতোমধ্যে, বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএফইডিএ) কাছে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে।
চলমান অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আমদানির জন্য পরিশোধিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৬১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ বেশি ছিল।
আমদানির পরিমাণ খুব বেশি না বাড়লেও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানির মূল্য বেড়ে গেছে, বিশেষত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে।
ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তির দিকে এবং দ্রুত এই পণ্যগুলো দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যায়, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ কমাতে সরকার আগামী দিনগুলোতে কয়েক দফা উদ্যোগ নেবে।
গত ১৫ জুন থেকে সরকার ১৩ লাখ ৯০ হাজার পরিবারের কাছে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করবে। ঢাকা ও বরিশাল শহর ছাড়া সারা দেশে এই কার্যক্রম চালু থাকবে।
কার্ডধারীরা তাদের ওয়ার্ডের সুনির্দিষ্ট ডিলার দোকান থেকে ভর্তুকি মূল্যে ২ লিটার সয়াবিন তেল, ২ কেজি ডাল ও ১ কেজি চিনি কেনার সুযোগ পাবেন।
এ ছাড়াও, কর্তৃপক্ষ ভারত থেকে জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) ব্যবস্থায় গম আমদানি করবে এবং আগামী মাসে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বাহ্যিক উৎস থেকে সরাসরি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে শুরু করবে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সয়াবিন ও অন্যান্য ভোজ্যতেলের আমদানি এবং একই সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়কে সয়াবিন, সরিষা ও সূর্যমুখীর উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানায়।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম জানান, সরকার আগামী বাজেটে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখবে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে গতকাল বলেন, 'এ ছাড়াও, আমরা বিদেশি ক্রয় জড়িত আছে এরকম প্রকল্পগুলো এখন বিবেচনা করবো না।'
'কম প্রাধান্যের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কয়েক মাসের জন্য বিলম্বিত করা হবে। আমরা এটাই নিয়ে কাজ করছি,' যোগ করেন তিনি।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments