‘রক্তের বন্ধনে রচিত বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ছিন্ন করা যাবে না’

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কালপঞ্জিতে অত্যন্ত স্মরণীয় একটি দিন ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালে এই দিনে ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রথমে ভারত এবং পরে ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় বিজয় অনিবার্য করে। 

আজ ৬ ডিসেম্বর ২০২১ দুপুর ২টায় বাংলাদেশকে ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতির ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচনার বিষয় ছিল: 'বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর ৫০ বছর।'

সংগঠনের সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম কে দোরাইস্বামী। 

আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত ভারতের স্টেটসম্যানের সাবেক সম্পাদক, লেখক সাংবাদিক মানস ঘোষ, মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত আকাশবাণী কলকাতার সাবেক প্রযোজক কবি পঙ্কজ সাহা, মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত বৃটিশ মানবাধিকার নেতা জুলিয়ান ফ্রান্সিস, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী মানবাধিকার নেত্রী আরমা দত্ত এমপি, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতার কন্যা ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, 'সম্প্রীতি' বাংলাদেশের সদস্য সচিব ও নির্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়ক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব এবং নির্মূল কমিটির বহুভাষিক সাময়িকী 'জাগরণ'-এর হিন্দি বিভাগীয় সম্পাদক ভারতের সাংবাদিক তাপস দাস।

সভাপতির প্রারম্ভিক ভাষণে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহীদ এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্যের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত বাংলাদেশের ১ কোটি সহায়সম্বলহীন শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠিত করেছে। দলমত নির্বিশেষে ভারতের সকল মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে একজোট ছিলেন। শরণার্থীদের বিশাল বোঝা বইতে গিয়ে তাদের অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ১৭ হাজার সদস্য শহীদ হয়েছেন। অন্য কোনো দেশকে স্বাধীন করার জন্য এ ধরনের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।'

শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেছিলেন নতুন রাষ্ট্রের মূলনীতি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা; যা ভারতেরও আদর্শ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব অর্জিত হয়েছে রক্তের মূল্যে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এই বন্ধুত্ব উপেক্ষা করতে চেয়েছে, অস্বীকার করতে চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অনন্যসাধারণ অবদান। ভারতের সহযোগিতার ভেতর এরা আবিষ্কার করেছে জন্মশত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করবার ষড়যন্ত্র। এরা বিশ্বাস করে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বে। এরা মনে করে পাকিস্তান ইসলামের দুর্গ, ভারত হিন্দু কাফেরদের দেশ। এদেরই প্রভুরা একাত্তরে ইসলামের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাধারণ মানুষ বার বার এই অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এবং আগামীতেও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির যাবতীয় ষড়যন্ত্র পরাজিত করে বাংলাদেশ বিজয়ের মহাসড়কে দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে।'

প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, '৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতির জন্য গর্বের দিন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণ আমাদের সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিলেন। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে জীবনদান করেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য জনসমর্থন তৈরি করেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করেন। বিজয়ের দুই মাসের মধ্যে ভারত তাদের সৈন্যদের ফিরিয়ে নেয়। এভাবে ভারতের সঙ্গে আমাদের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। গত ৫০ বছরে ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক; তার পরিধি আরও বাড়াতে হবে। এই সম্পর্ক নাড়ির সম্পর্ক। বেশকিছু অমিমাংসিত বিষয় ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেছেন। বাকি বিষয়গুলোও অচিরেই সমাধান করা হবে। এ অঞ্চলের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য ভারত এবং বাংলাদেশ পৃথিবীর সকল মঞ্চে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি আগামী দিনগুলোতে এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। আমাদের জনগণকে বোঝাতে হবে, ভারত আমাদের দুর্দিনের বন্ধু। এটি বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের সকলের। বাংলাদেশ-ভারতের সুসম্পর্ক সম্পর্কে সারাবিশ্বব্যাপী প্রচার করতে হবে। এ সকল বিষয়গুলো সামনে তুলে ধরার জন্য নির্মূল কমিটিকে ধন্যবাদ জানাই।'

বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে নির্মূল কমিটির আয়োজিত ওয়েবিনারে ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম কে দোরাইস্বামী বলেন, 'ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন উভয় প্রধানমন্ত্রীই ৬ ডিসেম্বরকে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দিবস হিসাবে ঘোষণা করেন। ভারত বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। সেই হিসেবে নির্মূল কমিটি বহু বছর ধরে '৬ ডিসেম্বর'-কে একটি ঐতিহাসিক দিন হিসেবে স্মরণ করে আসছে।'

এই ঐতিহাসিক দিনটিকে যথাযথভাবে উদযাপনের জন্য তিনি নির্মূল কমিটিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, জাপান, কাতার, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি বিশ্বের ১৮টি দেশে ভারতীয় ও বাংলাদেশি মিশন এ বছর ৬ ডিসেম্বর একসঙ্গে মৈত্রী দিবস উদযাপন করবে। মৈত্রী দিবস শুধুমাত্র উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন নয় বরং, এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বের স্বীকৃতিও।'

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা স্মরণ করে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন-এর সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, 'ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু প্রশিক্ষণই প্রদান করেনি তাদের অস্ত্রও প্রদান করে। তার বলেই মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীসহ অন্যান্য বন্ধুদের নামে বাংলাদেশে বিভিন্ন সড়ক ও স্থাপনার নামকরণ করতে হবে।'

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাক-চীনা ষড়যন্ত্র নিয়ে বিচারপতি মানিক আরও বলেন, 'পাকিস্তান আজও চীনকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি ঢাকায় পাকিস্তানী হাইকমিশন চালু রেখে তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। সুতরাং ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন বন্ধ করে সেখানে শুধু একটি কনসুলার সেকশন চালু করা উচিৎ।'

মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু বৃটিশ মানবাধিকার নেতা জুলিয়ান ফ্রান্সিস মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর আগের স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'আমি অক্সফামের হয়ে কলকাতা ও আগরতলার শরণার্থী শিবিরগুলোতে কাজ করেছি এবং প্রায় ৬ লাখ বাংলাদেশি শরণার্থীর দেখভালের দায়িত্বে ছিলাম।'

তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা স্মরণ করে বলেন, 'নভেম্বরের শেষে এবং ডিসেম্বরের শুরুতে শীতকালে শরণার্থীদের দুর্ভোগ যখন চরম সীমায় পৌঁছে এমন সময় পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত সহযোগিতা, বাংলাদেশে তাজউদ্দিনের সঙ্গে তার বৈঠকসহ কলকাতা, মুম্বাই ও কটক-এর তরুণ মেডিকেল ছাত্রদের ত্রাণকার্যে সহযোগিতা এবং চিকিৎসা সহায়তা কথা তার বক্তব্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।'

বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ওয়েবিনারে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত ভারতের স্টেটসম্যান-এর সাবেক সম্পাদক, লেখক সাংবাদিক মানস ঘোষ বলেন, 'নির্মূল কমিটির এই আয়োজন আগামী দিনে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। এ দুদেশের সম্পর্ক চিরসবুজ। আমি মনে করি, এ ধরনের আয়োজন বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অবদানকে বারংবার স্মরণের দ্বারা দুদেশের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে।'

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত আকাশবাণী কলকাতার সাবেক প্রযোজক কবি পঙ্কজ সাহা বলেন, 'ভারত পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে একটি বিল সংসদে উত্থাপন করলে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সেটিকে স্বাগত জানিয়ে ৬ ডিসেম্বর ৭১ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।'

চীন-পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে পঙ্কজ সাহা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, 'তাজউদ্দিন আহমেদ-এর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার বেশ সফলভাবেই ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অনেক দেশের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হন।'

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী মানবাধিকার নেত্রী আরমা দত্ত এমপি বলেন, 'আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমরা আজ প্রথম সরকারিভাবেও 'ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দিবস' পালন করছি। এই অর্জন আমরা বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহীদের পদতলে অর্পণ করছি এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবনদানকারী ভারতীয় সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি। নতুন প্রজন্মের সামনে ভ্রাতৃত্বের এই সম্পর্কের দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। ভারত ও বাংলাদেশের এই ভ্রাতৃত্ববোধ ও বন্ধুত্বের দৃঢ়তা রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে বিদ্যমান উভয় রাষ্ট্রের জন্যই জরুরি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিকভাবে জনমত গঠন, কূটনৈতিক তৎপরতা, স্বীকৃতি প্রদানসহ বহুভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন শুধুমাত্র তার মানবিকতা ও আদর্শের জন্য। স্কুল কলেজের পাঠ্যক্রমে ইন্দিরা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসব পদক্ষেপ তুলে ধরা উচিত।'

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চারণ করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতার কন্যা ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা আমার পিতা অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হত্যা করে। তখন আমার বয়স মাত্র পনেরো। বাবাকে হারিয়ে মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ফিরে চলেছেন তখন বাংলাদেশে মুসলমান ধর্মের মানুষ ব্যতিরেকে অন্য ধর্মের পরিচয় দেওয়া ছিল আত্মঘাতী। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মাকে নিয়ে আমি যখন ধানমন্ডির একটি বাড়িতে আত্মগোপন করে আছি এমন সময় রাস্তা থেকে স্বাধীন বাংলার জয়ধ্বনি 'জয় বাংলা' শ্লোগানে মুখরিত একটি বিশাল মিছিলের আওয়াজ শুনতে পাই। তখন আমার মনে হয়েছিল, আমারা নতুন জীবন পেলাম। সে স্মৃতি কখনো ভোলার নয়।'

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দুদেশের সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করে 'সম্প্রীতি' বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও নির্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়ক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, 'অতীতের মতো ভবিষ্যতেও দুদেশের সম্পর্ক অটুট থাকা চায়। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দুদেশের সম্পর্ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎপরতায় আজ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। দুদেশের বন্ধুত্বে দূরত্ব সৃষ্টিতে চীন ও পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র নিয়ে তিনি আরও বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই তারা আমাদের মৈত্রীবন্ধনে ফাটল ধরাতে চেয়েছে, যা আজও চলমান।'

নির্মূল কমিটির বহুভাষিক সাময়িকী 'জাগরণ'-এর হিন্দি বিভাগীয় সম্পাদক ভারতের সাংবাদিক তাপস দাস বলেন, 'আজকের দিনটি শুধুমাত্র ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্পর্কের জন্য গুরত্বপূর্ণ নয় বরং এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকদের কাছে গুরুত্ব পূর্ণ উদাহরণ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে এরকম বন্ধুত্বের কোনো উদাহরণ এখনো রচিত হয়নি। দীর্ঘ ৫০ বছরের ইতিহাসে এই সম্পর্ক নানাভাবে প্রশ্নের মুখে পড়লেও, বিগত ৫০ বছরে প্রতিটি ক্ষেত্রের এই দুদেশের সম্পর্ক বুঝিয়ে দিয়েছে, আগামী দিনে আমাদের একসঙ্গে পথচলা কতটা জরুরি। তবে আমাদেরকে '৭১-এর পরবর্তী প্রজন্মকে কিভাবে মুক্তি যুদ্ধের আদর্শে বলীয়ান করা যায় সে নিয়ে আরও কাজ করতে হবে।'

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক বক্তা ও শ্রোতাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল বলেন, 'গত ৫০ বছরে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বন্ধন যেমন অটুট ছিল তেমনি ভবিষ্যতেও সকল বাধা বিঘ্ন ও ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে আমাদের এই বন্ধন অটুট থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান চিরস্মরণীয়। এই ঋণ কখনো শোধ করার নয়। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ক। কারণ মুক্তিযুদ্ধে উভয় দেশের নাগরিক রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। আমাদের এই বন্ধুত্ব, এই সম্পর্ক চিরকাল অটুট থাকবে। রক্তের বন্ধনে রচিত বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী কখনও ছিন্ন করা যাবে না'।

Comments

The Daily Star  | English

Polls could be held in mid-February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus has said the next general election could be held in the week before the start of Ramadan in 2026.

1h ago