‘শরীফ উদ্দিনকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে অপসারণ করা হয়েছে’

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে গিয়ে জীবননাশের হুমকি পাওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে ১৬ ফেব্রুয়ারি চাকরিচ্যুত করেছে দুদক।
ACC
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে গিয়ে জীবননাশের হুমকি পাওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে ১৬ ফেব্রুয়ারি চাকরিচ্যুত করেছে দুদক।

দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, 'দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মো. শরীফ উদ্দিন (উপসহকারী পরিচালক) দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যক্রম, পটুয়াখালীকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন।'

দুদকের বিধিমালার ৫৪(২) ধারায় বলা হয়েছে— 'এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শাইয়া কোন কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা ৯০ দিনের বেতন নগদ পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারিবে।'

শরীফ উদ্দিনকে ৫৪(২) ধারায় চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অসদাচরণ বা কোনো দোষের কারণে ৫৪(২) ধারায় কাউকে চাকরিচ্যুত করা যায় না। চাকুরিবিধিতে এই ধারা থাকে তার কারণ হলো কেউ যখন কোনো কারণে কর্মীদের বেতন না দিতে পারে বা অন্যকোনো কারণে মন্দাঅবস্থা দেখা যায় বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো সমস্যা থাকে তখন তাকে ৯০ দিনের বেতন দিয়ে অপসারণ করা যাবে। তবে এটি কোনো অপরাধ, অসদাচরণ বা দোষের কারণে করা হয় না। এই ধারায় কেউ অপসারিত হওয়ার পর অন্যকোনো জায়গায় যদি চাকরি নিতে যান তাহলে তাকে কিন্তু বলতে হবে না যে, আমাকে অপরাধ বা অসদাচরণের কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।'

কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে ৫৪(২) ধারায় চাকরিচ্যুত করা যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কারো বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে তাহলে অবশ্যই ডিসিপ্লিনারি প্রসিজার অনুযায়ী যেতে হবে। সেই অভিযোগের তদন্ত হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তারপর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এগুলো হলো আইনের এ বি সি ডি। দুদকের কেউ যদি আইনের এই এ বি সি ডি গুলো না বুঝে তাহলে তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।'

তিনি বলেন, 'দুদক বলছে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে এভাবে অপসারণ করা যায় না। শরীফ উদ্দিনকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে অপসারণ করা হয়েছে।'

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, 'গত ২-৩ বছর ধরে চাকরিরত অবস্থায় সরকারি কোনো বড় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা হয়েছে বলে তো দেখিনি। পত্রিকার প্রতিবেদনে যা দেখেছি তাহলো শরীফ উদ্দিন অনেক সরকারি বড় কর্মকর্তার দুর্নীতির সম্পৃক্ততা পেয়েছেন। সরকারি বড় কর্মকর্তা ও রাজনৈতিকভাবে যারা বড় পদে আছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে তিনি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। গণমাধ্যমের সংবাদ পড়ে মনে হচ্ছে এই কারণেই তাকে বেআইনিভাবে অপসারণ করা হয়েছে।'

'এই অপসারণ দুদকে আর যারা আছেন, যারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন তাদের জন্য এক ধরনের হুমকি। তারা সবাই এখন আতংকে থাকবেন,' তিনি যোগ করেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শরীফ উদ্দিন এমন একজন ব্যক্তি যিনি বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনাগুলো উদঘাটন করছেন এবং যেসব প্রভাবশালী মহল বা সিন্ডিকেট এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টা করেছেন। তাকে এই ভাবে অপসারণ করা অত্যন্ত বিতর্কিত একটি ঘটনা।'

তিনি বলেন, 'যাদের দুর্নীতি উদঘাটনের জন্য শরীফ উদ্দিন সততার সঙ্গে, পেশাদারিত্বের সঙ্গে অগ্রসর হয়েছিলেন, কোনো অপশক্তির স্বার্থ দেখেননি, দুদকের উচিত ছিল তার পক্ষে দাঁড়ানো, তাকে সুরক্ষা দেওয়া, তাকে সমর্থন করা, নিরাপত্তা দেওয়া। তা না করে তাকে কেন অপসারণ করা হলো এই প্রশ্নটি ওঠা স্বাভাবিক। যারা শরীফ উদ্দিনের উদ্যোগের কারণে নাখোশ হয়েছেন, বিরাগভাজন হয়েছেন তাদের প্ররোচনা, তাদের নির্দেশনায় তাকে অপসারণ করা হয়েছে কি না এই প্রশ্ন ওঠাটাও অনেকটা যৌক্তিক। দুদককে অবশ্যই এর জবাব দিতে হবে।'

শরীফ উদ্দিনের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'শরীফ উদ্দিন এখন যে নিরাপত্তাহীনতায় আছেন, রাষ্ট্রের কাছে দাবি হবে, আহ্বান হবে অবশ্যই তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া। কারণ তিনি রাষ্ট্রের স্বার্থ-সুরক্ষার জন্য কাজ করেছেন, এ জন্য তাকে ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাকে চাকরি থেকে অপসারিত হতে হয়েছে, পাশাপাশি তিনি জীবনের নিরাপত্তার হুমকিতে আছেন।'

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'তিনি যে এই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এর দায় দুদক কখনই এড়াতে পারে না। এর দায় দুদককে নিতে হবে। দুদক তার পাশে দাঁড়াতে পারতো, তাকে সুরক্ষা দিতে পারতো। এখনো তাদের নৈতিক দায়িত্ব হবে তার পাশে দাঁড়ানো। কারণ শরীফ দুদকের জন্যই কাজ করেছেন।'

'দুদকের দায়িত্ব হলো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বাস্তবে তারা দুর্নীতিকে সুরক্ষা দিচ্ছে বলে আমি মনে করি। রাঘববোয়াল, সিন্ডিকেট যারা দুর্নীতি করছেন তাদের স্বার্থ-সুরক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক নিজেকে প্রমাণিত করল। দুদকের যেখানে দায়িত্ব দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা, সেটি না করে, সেখানে থেকে সরে এসেছে। যারা দুর্নীতি করে, যারা রাজনৈতিকভাবে, প্রশাসনিকভাবে, আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান এ ধরনের মানুষ যারা দুর্নীতির সঙ্গে লিপ্ত তাদের সুরক্ষা দেওয়ার একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছে দুদক। যে লক্ষ্য নিয়ে দুদক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দুদকের এই অবস্থান সেই লক্ষ্যেকে আসলে পদদলিত করা হয়েছে। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তাদের দ্বারা প্রভাবিত একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে দুদক।'

নাম প্রকাশ না করা শর্তে দুদকের এক উপপরিচালক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাষ্ট্রের অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তারা যেভাবে চলে আমাদেরও সেভাবে চলতে দেওয়া উচিত। সংবিধান ব্যক্তি ও পেশার স্বাধীনতা দিয়েছে। কাউকে কোনো চাকরি থেকে তার ব্যাখ্যা না নিয়ে অপসারণ করা যাবে না। মো. শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ মানেই স্বাধীনভাবে কাজ করার একটি অন্তরায়। এর ফলে অনেকেই কাজ করতে ভয় পাবেন।'

এ বিষয়ে দুদকের এক সহকারী পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

Comments

The Daily Star  | English

Submarine cable breakdown disrupts Bangladesh internet

It will take at least 2 to 3 days to resume the connection

46m ago