সংকটের কারণ গ্যাস অনুসন্ধান না করে এলএনজি আমদানি

বদরূল ইমাম
বদরূল ইমাম।

দেশের বর্তমান জ্বালানি সংকটের পেছনে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান না করাই বেশি দায়ী বলে মনে করেন প্রখ্যাত জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম।

গত শনিবার  দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে আয়োজিত এক আলোচনায় তিনি বলেন, 'গত ২০ বছরে বাংলাদেশ মাত্র ২৬টি কূপ খনন করেছে, যা তেল-গ্যাস তথা হাইড্রোকার্বন পাওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা আছে এমন দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক বদরূল ইমামের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জ্বালানি নিরাপত্তায় বাংলাদেশের দুর্বলতাকে উন্মোচন করেছে কেবল। এর মূল কারণ গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেওয়ার বদলে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা।

তিনি আরও বলেন, 'আজকের এই সংকট হঠাৎ করে আসেনি। এটি ধীরলয়ে কিন্তু নিশ্চিতভাবে এসেছে। আমরা আগেই বলেছিলাম, এমন একটি সময় আসবে যখন এই ধরনের সংকট দেখা দেবে।'

এত স্বল্পহারে অনুসন্ধান চালিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বদরূল ইমামের বক্তব্য, 'এই সংকট সরকারের ভুল পরিকল্পনা এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির সিদ্ধান্তের ফল। এই সংকট তৈরি হচ্ছিল এবং যেকোনো সময় তা দেখা দিতে পারত।'

তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৮ সালের শেষে দিকে সরকার যখন এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়, তখন দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এর প্রতিবাদ করেছিলেন। কারণ এলএনজির দাম প্রায়ই আন্তর্জাতিক বাজারে ওঠানামা করে।

তিনি বলেন, 'কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত থাকলেও সরকার বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রতি কোনো গুরুত্ব দেয়নি। বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম এখন ৪০ ডলার। বিপরীতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ১-৩ ডলার।'

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদ আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশে ৩টি কূপ খনন করলে ১টিতে গ্যাস পাওয়া যায়, যেখানে বৈশ্বিক গড় ৫টি। আমাদের কাছে জরিপ প্রতিবেদন আছে এবং আমরা জানি যে, দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ গ্যাসসম্পদ এখনো অনুসন্ধান করা হয়নি।'

দুই দশকেরও বেশি সময় আগে পরিচালিত ২টি গবেষণার বরাত দিয়ে বদরূল ইমাম জানান, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে ও রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোবাংলা যৌথভাবে যে জরিপ চালিয়েছিল, তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে।

তার ১ বছর পর নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আরেক গবেষণায় দেখানো হয়, মজুত গ্যাসের সম্ভাব্য পরিমাণ ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।

এই অধ্যাপক বলেন, 'আমাদের প্রবণতা হলো এমন জিনিসগুলোর সন্ধান করা যা আমরা সহজেই খুঁজে পেতে পারি। কিন্তু অনুসন্ধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়টি আমরা করছি না।'

তার বক্তব্য, '২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে ৩ দশকের পুরোনো বিরোধের অবসান হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরের ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকার প্রায় চার পঞ্চমাংশের ওপর বাংলাদেশের দখল প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু সেখানে অফশোর অনুসন্ধানের জন্য ব্যাপক কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি।'

মিয়ানমার এর মধ্যে সাগরে তাদের ব্লক থেকে চীনে গ্যাস রপ্তানি শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'ভারত ও মিয়ানমার যখন সাগরে তাদের অংশে প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছে, তখন আমরা ১টি জরিপও পরিচালনা করতে পারিনি।'

সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে প্রেট্রোবাংলা ২০১৫ সালে একটি 'মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে' পরিচালনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আমন্ত্রণ জানাতে এটি একটি দরকারি পদক্ষেপ। কিন্তু জ্বালানি মন্ত্রণালয় এটি বাতিল করে দেয়। 

পরের বছর নতুন করে একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই নরওয়ের টিজিএস ও যুক্তরাষ্ট্রের শ্লমবার্গারের একটি যৌথ কনসোর্টিয়াম দরপত্রে বিজয়ী হলেও তারা কাজ শুরু করতে পারেনি।

বদরূল ইমাম বলেন, 'আমরা এখনো এর ভাগ্য সম্পর্কে জানতে পারিনি। এটা খুবই দুঃখজনক।'

মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে পরিচালনায় সরকারের কোনো খরচই হতো না। কারণ এই জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা আন্তুর্জাতিক তেল সংস্থাগুলোর কাছে জরিপ প্রতিবেদন বিক্রি করে এবং যে দেশে জরিপটি পরিচালিত হয়, সেই দেশে আয়ের একটি অংশ দেয়।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির ভেতর সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এর অংশ হিসেবে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ এবং দেশব্যাপী ১ থেকে ২ ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া খণ্ডিত পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বদরূল ইমামের অভিমত, এমন গোঁজামিলের সিদ্ধান্ত এই সংকটের সমাধান করবে না। আমাদের মূল জায়গায় ফিরে যেতে হবে। এ জন্য সরকারের উচিত সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

তিনি বলেন, 'এই সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি আমাদের কাছে আছে। আমাদের এমন গ্যাসের মজুদ খুঁজে বের করতে হবে যা এখনও অজানা রয়ে গেছে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্যাস উত্তোলন করতে হবে।'

স্থানীয় উৎসগুলো থেকে জ্বালানি উৎপাদনের বিষয়টি আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, এলএনজি আমদানিতে দেশ বছরে ৪৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে, যা গ্যাসের মোট চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ পূরণ করে।

ভোলার অব্যবহৃত গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, সেখান থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহের জন্য একটি পাইপলাইন দরকার। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে এমন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকার ভোলায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি হাব করতে পারে। কিন্তু সেটাও তারা করে না।'

এ ছাড়া দেশে গ্যাসের বর্তমান মজুত ও বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের ওপর নির্ভরতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, যেখান থেকে দেশের ৫০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করা হয়।

তিনি বলেন, 'রোজার আগে প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে বিবিয়ানা কিছু সময়ের জন্য ৬টি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। তখন এই গ্যাসের উপর নির্ভরশীল আবাসিক, শিল্প এবং অন্যান্য খাতগুলো তার অভাব টের পেয়েছিল। বিবিয়ানায় গ্যাস উৎপাদন ৩ থেকে ৪ বছর পর কমতে শুরু করবে। তখন কী হবে?'

গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে অগ্রাধিকার না দিয়ে বাপেক্সকে শক্তিশালী করার তাগিদ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, 'বাপেক্স ভোলার গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করার পর সরকার সেটা থেকে উৎপাদনের জন্য রাশিয়ার গ্যাজপ্রমকে দায়িত্ব দিলো?'

তিনি জানান, একটি বিদেশি কোম্পানি একটি কূপ খননের জন্য যেখানে ১৮০-২০০ কোটি টাকা নেয়, সেখানে বাপেক্স এটি ৭০ থেকে ১০০ কোটি টাকায় করে ফেলতে পারে।

বদরূল ইমাম আরও জানান, চলতি বছরের শুরুতে বাপেক্স যখন পরের ৫ বছরে ৫৫টি কূপ খননের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তিনি রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, 'এর মানে হলো বছরে ১১টি অনুসন্ধানমূলক ড্রিলিং করা হবে। আমরা যদি কমপক্ষে ৩ থেকে ৪টি ড্রিলিং করতে পারি তবে পুরো দৃশ্যটি পরিবর্তন হয়ে যেত। কিন্তু কোনো এক দিন, পুরো বিষয়টি বাতিল হয়ে যায়। আমি জানি না কেন তারা এটি বাতিল করেছে।'

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
road accidents death in Bangladesh April

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

2h ago