সবচেয়ে বেশি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ: জাতিসংঘ
জাতিসংঘের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশ স্থান পেয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভূগর্ভস্থ পানি বিজ্ঞান পরিদপ্তরের পরিচালক আনোয়ার জাহিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিষয়টি খুবই আশংকাজনক যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত শেষ হয়ে আসছে।'
তিনি আরও জানান, ঢাকা ছাড়াও এর আশেপাশের অঞ্চল এবং কিছু কিছু পল্লী এলাকাতেও দ্রুত পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।
'দ্রুত নিঃশেষিত হওয়ার কারণে সুপেয় পানির উৎস কমে আসবে। একই সঙ্গে, আমাদের কৃষি ও শিল্প খাতও সমস্যায় পড়বে,' যোগ করেন জাহিদ।
'মেকিং দ্য ইনভিসিবল ভিসিবল' শিরোনামে জাতিসংঘের বৈশ্বিক পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পানি উত্তোলনকারী বাকি ৬ দেশ হলো চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্ক।
গতকাল প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ৭টি দেশ সম্মিলিতভাবে বিশ্বের ৬০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে থাকে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সুপেয় পানির উৎস হচ্ছে মাটির নিচে সঞ্চিত পানি। তবে এ বিষয়টি নিয়ে সবার সঠিক ধারণা নেই। ফলে এর সঠিক মূল্যায়ন হয় না এবং প্রায়ই এই প্রাকৃতিক সম্পদ অব্যবস্থাপনা ও অপব্যবহারের শিকার হয়।
জাতিসংঘের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ বছরে ৩০ ঘন কিলোমিটার এলাকা থেকে পানি উত্তোলন করেছে এবং ৮৬ শতাংশ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করেছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা ২০১৮ সালে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনের সূত্র দিয়ে জানান, প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য ব্যবহৃত ভূমির প্রাক্কলিত পরিমাণ ৩২ ঘন কিলোমিটার।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তোলন করা পানির প্রায় ৯০ শতাংশ সেচ কাজে এবং বাকি ১০ শতাংশ গৃহস্থালি কাজে ও শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। এই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল 'মাল্টি-হ্যাজার্ড গ্রাউন্ডওয়াটার রিস্কস টু দ্য ড্রিংকিং ওয়াটার সাপ্লাই ইন বাংলাদেশ'।
প্রতি বছরই আশংকাজনক হারে বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের হার, যেটি দেশের জলাধারগুলোর প্রতি মারাত্মক হুমকি এবং এটি একই সঙ্গে খরা ও দূষণের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৫ থেকে ২৪ শতাংশ ভূমি এলাকা উচ্চ পর্যায়ের আর্সেনিক, লবণাক্ততা ও ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়ার আশংকায় আছে।
এ ছাড়াও, প্রতিবেদনে পূর্বাভাষ দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত মানুষ উল্লেখিত সমস্যাগুলোয় আক্রান্ত হওয়ার উচ্চঝুঁকিতে আছেন।
এই ৮৬ লাখ মানুষের মধ্যে ২২ লাখই দারিদ্রসীমার নিচে আছেন।
বাংলাদেশ প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক তানভীর আহমেদ জানান, ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনে সুপেয় পানির সংকট এবং উপকূলীয় এলাকাগুলোতে লবণাক্ততা দেখা দিতে পারে।
'কিছু কিছু জায়গায় মাটি দেবে যেতে পারে,' যোগ করেন তিনি।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় ইতোমধ্যে বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর গৃহস্থালি ব্যবহারের চাহিদার অর্ধেক পূরণ করছে এবং উত্তোলিত পানির ২৫ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে বিশ্বের ৩৮ শতাংশ সেচ কার্যক্রমের আওতায় থাকা জমিতে।
ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় নিঃশেষ হয় যখন উত্তোলনের হার পরিপূরণের হারের চেয়ে বেশি থাকে। যদিও এ ক্ষেত্রে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় ভূমিকা রাখে, তবুও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটের পেছনে মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনই দায়ী।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বৈশ্বিক ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসছে। বর্তমান শতকের শুরুতে পূর্বাভাষ দেওয়া হয়েছিল, বছরে ১০০ থেকে ২০০ ঘন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পানির সঞ্চয় কমতে থাকবে, যেটি সামগ্রিক উত্তোলনের ১৫ থেকে ২৫ শতাংশের সমতুল্য।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়, যার ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করা হয়।
মাটির ওপরের উৎস থেকে বাকি চাহিদা মেটানো হয়।
ডিপিএইচইর গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ম. সাইফুর রহমান জানান, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ পানি চাষাবাদে ব্যবহার হয়। বাকি চাহিদার ৬ শতাংশ শিল্প ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতে এবং ৪ শতাংশ ব্যবহার হয় পান করার ও গৃহস্থালি কাজের জন্য।
ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০০ ফুট গভীর পর্যন্ত গভীরতায় পানি উত্তোলনের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, টঙ্গী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে, যোগ করেন তিনি।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments