গাজীপুর সিটি করপোরেশন: উন্নয়নের নামে সবই বৈধ!

সরকারি আইন মানলে কিছু করতে পারবেন না: মেয়র জাহাঙ্গীর

সিটি করপোরেশন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ‘দখল’ করে নেওয়ায় এবং রাস্তাঘাট, ড্রেন ও ফুটপাত প্রশস্ত করার জন্য ভবন ভেঙে দেওয়ায় গাজীপুর শহরের কয়েক হাজার বাসিন্দা নিজেদের জমি হারিয়েছেন।
জিসিসি মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। ছবি: সংগৃহীত

সিটি করপোরেশন ব্যক্তিগত সম্পত্তি 'দখল' করে নেওয়ায় এবং রাস্তাঘাট, ড্রেন ও ফুটপাত প্রশস্ত করার জন্য ভবন ভেঙে দেওয়ায় গাজীপুর শহরের কয়েক হাজার বাসিন্দা নিজেদের জমি হারিয়েছেন।

জমি মালিকদের অভিযোগ, ভূমি অধিগ্রহণ না করেই চলতি বছরের শুরুতে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা হয় নিজেরাই বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে দিয়েছে, না হয় মালিকদেরকে যার যার আবাসিক ভবন, কারখানা, দোকান বা সীমানা প্রাচীর আংশিকভাবে ভাঙতে বাধ্য করেছে।  

তবে, বেশিরভাগ বাসিন্দাই কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। উল্টো নিজেদের জমিতে সিটি করপোরেশনের ফেলে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়েছে অনেককে। এ ছাড়া, ব্যক্তিগত জমির কয়েকশ গাছও কেটে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

অবশ্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (জিসিসি) দাবি, এই প্রকল্প দুটিতে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো বিধান নেই।

২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত দুটি প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্তকরণ এবং ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণের কাজ করছে জিসিসি। এ কাজটি করতে গিয়ে অন্তত ৩টি ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দেওয়া ২টি আদেশ লঙ্ঘন করেছে তারা।

জমি হারানো ১০০ জনের বেশি মানুষ জিসিসির কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করে গত বছর থেকে হাইকোর্টে পৃথক রিট পিটিশন দাখিল করেছেন। বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

স্থানীয়রা এবং নাম প্রকাশ না করার শর্তে জিসিসির এক কর্মকর্তা জানান, অল্প পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে ১০০টির মধ্যে ৯৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে জিসিসি।

'টাকা দিন, আমরা জমি কিনব'

হাড়িনাল এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, দেড় কাঠা জমিসহ বাড়ির কিছু অংশ হারাতে হয়েছে তাকে।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'চার কাঠা জমির ওপর বাড়ি বানিয়েছিলাম। অধিগ্রহণ না করেই সিটি করপোরেশন আমার বাড়ির কিছু অংশ ও দেয়াল ভেঙে ফেলেছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমি কিছুই পাইনি।

রফিকুল আরও বলেন, 'মেয়র তার সহযোগীদের মাধ্যমে আমাদেরকে তার অফিসে ডেকেছিলেন। আরও বেশ কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্তের সঙ্গে আমি সেখানে দুবার গিয়েছি। কিন্তু, তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি।'

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় হরিনাল, বাইমাইল, পূবাইল, বসুগাঁও, কোনাবাড়ী ও ইটাহাটা এলাকার ২ ডজনেরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ রফিকুলের মতোই চরম হতাশা প্রকাশ করেন। ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কায় তাদের বেশিরভাগই নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

তবে, গত ৩০ আগস্ট যোগাযোগ করা হলে মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, '৯৫ শতাংশ বাসিন্দা নিজেদের ভালোর জন্য স্বেচ্ছায় জমি ছেড়ে দিয়েছেন। বাকি পাঁচ শতাংশ হয়তো এ নিয়ে বিচলিত হয়েছেন।'

প্রায় ৩০ হাজার স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।

ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মেয়র বলেন, 'আপনি যদি সরকারি আইন মেনে চলেন, তাহলে এখানে কিছু করতে পারবেন না। টাকা দিন। আমরা জমি কিনব।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের ৪০ লাখ বাসিন্দা আছে। আমরা যা করছি, তাদের কল্যাণের জন্য করছি। আমি মানুষের জন্য রাস্তা প্রশস্ত করছি। আপনার বরং কোনো দুর্নীতি ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।'

তিনি উল্লেখ করেন, প্রায় ৮১ কিলোমিটার রাস্তার সম্প্রসারণ কাজে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সিটি করপোরেশনের সংগৃহীত রাজস্ব থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, ৭০০ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্ত করার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কিছুই নেই।

তহবিলের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা ক্ষতিপূরণ পাননি বলে জানান মেয়র।

জিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের সময় ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো মহানগরে জমি অধিগ্রহণ ছাড়া কোনো উন্নয়ন কাজ করা যাবে না। কিন্তু, প্রকল্প ২টি হাতে নেওয়া হয় গাজীপুর মহানগর হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগে।

জিসিসি জমি অধিগ্রহণ না করে রাস্তার কাজ প্রসারিত করতে পারে কিনা জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, 'এরকম হওয়ার কথা নয়।'

গত শুক্রবার তিনি বলেন, 'আমি এর আগেও এমন কিছু অভিযোগের কথা শুনেছি। কিন্তু, আমরা কখনো কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাইনি।'

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম স্বীকার করেন, বেশ কয়েকজন তার সঙ্গে এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু, কেউ লিখিত অভিযোগ না করায় তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।

হাইকোর্টের স্থিতাবস্থার আদেশ 'লঙ্ঘন'   

হাইকোর্ট ক্যাসেম ল্যাম্পস লিমিটেডের জমি, বাইমাইলে কাসেম গ্রুপের গেস্ট হাউস এবং মজলিশপুরের ইটাহাটাতে এসকর্ট প্যাকেজিং ফ্যাক্টরির সম্পত্তি দখলের বিষয়ে স্থিতাবস্থা আদেশ দিয়েছিলেন। এই আদেশ সত্ত্বেও, গত ১৯ ও ২০ আগস্ট কাসেম ল্যাম্পস লিমিটেডের কারখানা ও গেস্ট হাউসের দখলে নেয় জিসিসি।

দুটি রিট আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট গত বছরের ২ নভেম্বর এবং চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি গেস্টহাউস ও কাসেম ল্যাম্পস লিমিটেডের জমি দখলের বিষয়ে স্থিতাবস্থার আদেশ দিয়েছিলেন।

এ আদেশ ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করায় কেন মেয়র ও দুই কাউন্সিলের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না-সেই বিষয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।

জিসিসির কর্মচারীরা গত ২০ আগস্ট কাসেম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডেরও জমি দখলে নেন।

কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, দুটি শতবর্ষী বটগাছ, ঝাউ ও রাবার গাছসহ তাদের ১৫৮ টি গাছও কেটে ফেলেছে সিটি কর্পোরেশন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় এই সংবাদদাতা কাসেম গ্রুপের ২টি কারখানা এবং গেস্টহাউসের সীমানা প্রাচীর ও প্রবেশদ্বার বুলডোজারে ভাঙা অবস্থায় দেখতে পান।

কারখানার ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তারিক আবুল আলা বলেন, 'হাইকোর্টের স্থিতাবস্থার আদেশ কাসেম ল্যাম্পস লিমিটেডের গেইটে ঝোলানো ছিল। কিন্তু, মেয়রের আদেশে তারা গেইট ভেঙে ফেলে।'

তবে, হাইকোর্টের আদেশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মেয়র জাহাঙ্গীর বলেন, 'আমি হাইকোর্টের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ ধরনের কোনো আদেশ লঙ্ঘন করিনি।'

১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্বাস উদ্দিন খোকন দাবি করেন, স্থিতাবস্থার সময় পার হওয়ার পর সিটি কর্পোরেশন এই ব্যবস্থা নিয়েছে।

ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।

কাসেম গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক শামীম রেজা খান জানান, ঘটনার পরপরই তিনি কোনাবাড়ী থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু, পুলিশ মামলা বা সাধারণ ডায়েরি নেয়নি।

পরে তার কোম্পানি গত ২৯ আগস্ট গাজীপুর আদালতে মামলা করে।

কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক জানান, জিসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী তাকে বলেছেন, হাইকোর্ট স্থিতাবস্থার আদেশটি বাতিল করেছেন।

মামলা না নেওয়ার বিষয়ে ওসি বলেন, অভিযোগকারী তাকে আগে তদন্ত করে তারপর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।

অন্যান্য ভুক্তভোগী

বাইমাইল এলাকায় কাসেম গ্রুপই একমাত্র ভুক্তভোগী নয়। জিসিসি প্রায় ২০০ জনের ব্যক্তিগত জমি দখল করেছে এবং তাদের বাড়ি, দোকান ও সীমানা প্রাচীরের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেছে।

হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘনের আরেকটি উদাহরণ দেখা যায় মজলিশপুরের ইটাহাটার এসকর্ট প্যাকেজিং কারখানায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারখানা মালিকের এক আত্মীয় জানান, গত ১০ জুন সকাল ১১টার দিকে লোকজন বুলডোজার নিয়ে কারখানায় প্রবেশ করে এবং ৫টি কংক্রিটের পিলার ও বেসমেন্টের কিছু অংশ ভেঙে ফেলে।

কারখানার মালিকের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গত ৮ জুন স্থিতাবস্থার আদেশ দেওয়ার মাত্র ২ দিন পর এই ঘটনা ঘটে।

কারখানা মালিকদের আত্মীয় বলেন, 'আমাদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমরা  স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে পড়েছি।'

অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

Trade at centre stage between Dhaka, Doha

Looking to diversify trade and investments in a changed geopolitical atmosphere, Qatar and Bangladesh yesterday signed 10 deals, including agreements on cooperation on ports, and overseas employment and welfare.

4h ago