সালাউদ্দিনের মাটির বেহালায় পথের সুর

মো. সালাউদ্দিন। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

কাঁধে ঝোলা, লম্বা চুল আর রোদে পোড়া তামাটে চামড়ার মানুষটি যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা গল্পের কোনো চরিত্র। ৪ দশক ধরে মাটির তৈরি বেহালায় জনপ্রিয় সব গানের সুর বাজিয়ে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছেন ঢাকা নামের এই ঊষর মহানগরের অলিতে-গলিতে।

মিরপুরের উত্তর বিশিল এলাকার বাসিন্দা ওই বেহালাবাদকের নাম মো. সালাউদ্দিন। তার ভাষ্য অনুসারে, সংগীত তার আত্মার আত্মীয়। মাটি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি এক তারের বেহালা বিক্রি করেই তার অন্নের সংস্থান হয়। এর বিনিময়ে সুরে সুরে শহরের খেটে খাওয়া ঊণমানুষদের দুঃখে যত্নের প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি।

মাটি-বাঁশের বেহালায় সালাউদ্দিনের তোলা সুর শুনে কখনো কখনো ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন বাড়ির বউ-ঝি'রা। অনুরোধ করেন পছন্দের কোনো সুর বাজাতে। আবার চলতি পথে তার পিছু নেয় পাড়ার ছোট ছেলে-মেয়েদের দল। উত্তর বিশিলসহ মিরপুরের পল্লবী, মাজার রোড, শেওড়াপাড়া, পর্বতাসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা এই দৃশ্যের সঙ্গে কম-বেশি পরিচিত।

সম্প্রতি সালাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয় পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামিম সরণির গলিতে। যথারীতি কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে বেহালা বাজিয়ে পথ হাঁটছিলেন তিনি। আর পেছনে ছিল অনুগামী শিশুদের দল।

এই দৃশ্য কাউকে মনে করিয়ে দিতে পারে শিল্পী কবীর সুমনের 'ও গানওলা' গানটির কথা। নোবেল বিজয়ী গীতিকবি বব ডিলানের মি. ট্যাম্বোরিন ম্যান-এর ছায়া অবলম্বনে লেখা ওই গানেও এমন এক বাদকের দেখা মেলে। সুমন যাকে ডেকেছেন 'গানওলা' নামে।

একদিন ঘুমভাঙা সকালে গানের ছেলেটার যখন কোথাও যাওয়ার ছিল না, করার মতো ছিল না কিছুই, তখন সে গানওলাকে অনুরোধ করেছিল আরেকটি গান গাইবার জন্য। গানেই সে বলে উঠেছিল, 'ছেলেবেলার সেই বেহালা বাজানো লোকটা/ চলে গেছে বেহালা নিয়ে/ চলে গেছে গান শুনিয়ে।'

মনে প্রশ্ন আসে, 'এই পাল্টানো সময়ে', চেনা নাগরিক পরিসরে সেই বেহালা বাজানো লোকটিই কি আবার ফিরে এলো?

কথা হয় সালাউদ্দিনের সঙ্গে। রাস্তার পাশের একটি ছাপড়া চায়ের দোকানে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তার কিছু ভক্ত-গুণগ্রাহীরাও জুটে যান।

সালাউদ্দিন জানান, ৪০ বছর ধরে এভাবেই তিনি ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় বেহালা বাজিয়ে চলেছেন। এক তারের এই বেহালা বিক্রি করেই তার দিন চলে।

তিনি বলেন, 'মানুষের ভালোবাসাই আমাকে এই পেশায় টিকিয়ে রেখেছে। অনেকে আমার বাজনা পছন্দ করে। কেউ কেউ খুশি হয়ে বাচ্চার জন্য একটি বেহালা কিনে নিয়ে যায়। আমাকে সম্মান করে। এটাই আমার সার্থকতা।'

সালাউদ্দিনের বেহালার মূল কাঠামো বাঁশের। তার এক প্রান্তে মাটির ছোট পাত্রের ওপর পাতলা চামড়ার আবরণ। বাঁশের ছড়ে যুক্ত প্লাস্টিকের সুতা। প্রতিটি বেহালা তিনি বিক্রি করেন ১০০ টাকায়। প্রতিদিন ৫০টির মতো বেহালা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। মেলা-পার্বণে বিক্রির পরিমাণ বাড়ে।

তবে সালাউদ্দিনের হাতের বেহালাটি বিশেষ ধরনের। এর ছড় আসল বেহালার ছড়ের মতোই, ঘোড়ার লেজের লম্বা লোম দিয়ে তৈরি। এই ছড়সহ বেহালা কিনতে ক্রেতাকে প্রায় ১ হাজার টাকা খরচ করতে হবে।

সালাউদ্দিন জানান, তিনি মাটি-বাঁশের এই বেহালার নাম দিয়েছেন 'বাংলা বেহালা'। সেই ব্রিটিশ আমলে তার দাদা বাচ্চু মিয়া আসাম থেকে ঢাকায় এসে থিতু হয়েছিলেন, যিনি ছিলেন এমন মাটির বেহালার বাদক। তারপর সালাউদ্দিনের বাবা মনু মিয়ার হাত ধরে এই বেহালা বাজানো শেখেন সালাউদ্দিন।

সালাউদ্দিনের দাবি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাবা মনু মিয়ার বাজনা পছন্দ করতেন। তখন তারা থাকতেন চানখাঁরপুল এলাকায়। এমনকি বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামালও কিছুদিন মনু মিয়ার কাছে এই বেহালা বাজানো শিখেছিলেন।

এখন সালাউদ্দিন তার ১১ বছরের নাতনি সাইমাকে এই বেহালা বাজানো শেখাচ্ছেন। তবে তার ছেলেদের কেউ বাবার পেশা গ্রহণ করেনি।

সালাউদ্দিনের সঙ্গে কথোপকথনে তার একটি দার্শনিক সত্তার পরিচয়ও পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির ধার খুব একটা ধারেন না। পথের সব মানুষকেই বন্ধু মনে হয় তার। তার ভাষ্য, শিল্পীর জীবনে কষ্ট থাকবেই।

কেবল বেহালা বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চলে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আগে এক রকম চলে যেত। দৈনিক বিক্রির পাশাপাশি আগে বিভিন্ন মেলায় যেতাম। আয় খারাপ হতো না। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আর সেটা পারি না।'

পথ হেঁটে হেঁটে মানুষকে আনন্দ দিয়ে বেড়ানো এই মানুষটির বয়স এখন ৬৩। নিজে অসুস্থতায় ভুগছেন, ঘরে স্ত্রীর শরীরটাও ভালো না। প্রতি মাসে ওষুধের পেছনেই চলে যায় আয়ের একটি বড় অংশ। ভাড়া বাড়িতে থাকেন। সঞ্চয় নেই।

এ অবস্থায় এখন বেশ অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তার বোধ পেয়ে বসেছে এই বেহালাবাদককে। কথায় কথায় জানালেন, 'বাংলাদেশ টেলিভিশনে চাকরির খুব শখ ছিল। মাসে নির্দিষ্ট কিছু আয়ের ব্যবস্থা থাকলে চাপ অনেকটা কমে যায়। যদি এমন কিছু সম্ভব হয়, তাহলে অনেক ভালো হতো।'

কথা শেষে আবার পথ হাঁটতে শুরু করেন সালাউদ্দিন। তার বেহালায় বেজে ওঠে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ও সত্য সাহার সুরারোপিত গান, 'নীল আকাশে নিচে আমি, রাস্তা চলেছি একা'।

প্রায় ২ কোটি জনসংখ্যার এই নগরে সালাউদ্দিনকে তখন সত্যিই একা মনে হয়।

ছবি: স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Had no discussion on ‘humanitarian corridor’ with UN or any entity: Shafiqul

Regarding the reports of involvement of a major power, he said, these are 'pure and unadulterated' propaganda.

2h ago