হস্তান্তরের আগেই উড়ে গেছে টিন, বসবাস অনুপযোগী আশ্রয়ণ প্রকল্প

দূর থেকে দেখলে যে কারো মনে হতে পারে অনেক পুরনো কোনো ঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বিষয়টি আংশিক ঠিক। ঘরগুলো পরিত্যক্ত হলেও পুরনো নয়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, ঘরগুলো মাত্র ১ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন।
বলছি বিশ্বনাথপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের কথা। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার বিশ্বনাথপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই ঘরগুলো উদ্বোধন করেন।

এখানে ৫টি ব্যারাকে ২৫টি ঘর আছে। সেগুলোর মধ্যে উদ্বোধনের আগেই ৫টি ঘরের টিন ঝড়ে উড়ে যায়। উদ্বোধনের ৩ মাসের মধ্যে আরও ৫টি ঘরের টিন উড়ে যায়। বাকিগুলোর অবস্থাও বসবাসের উপযোগী নয়। যে কোনো সময়ে উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তা ছাড়া কয়েকটি ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে।

গত সোমবার দ্য ডেইলি স্টার সরেজমিনে দেখতে পায়, টিন উড়ে যাওয়া ঘরগুলোর পাশে টিনের বেড়া তৈরি করে বেশ কয়েকটি খুপড়ি ঘর করা হয়েছে। এই খুপড়ি ঘরগুলোতে থাকেন মো. আইনুল হোসেন (৫০), মো. মজিদ (৫০), আনোয়ারা বেগম (৭০), মোসা. মোমেনা (৭০)।
আইনুল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদেরকে যে ঘর দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর টিন উড়ে গেছে। যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। তাই এখানেই খুপড়ি ঘর তৈরি করে আছি।'
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মো. আসাদুলের (৩৮) সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়। তিনি বলেন, '২৫টি ঘরের মধ্যে মাত্র ৯টি ঘরে মানুষ থাকেন। বাকিগুলো থাকার উপযোগী নয়। ১০টি ঘরের কোনো টিন নেই। ৫টি ঘরে কোনো মতো টিন তুলে রাখা হয়েছে। যেসব ঘরের টিন হস্তান্তরের আগেই উড়ে গেছে সেগুলোতে থাকার জন্য পরবর্তীতে আর কেউ আসেননি।'
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বর্তমান বাসিন্দা মোসা. রোজিনা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঝড়ে ঘরগুলোর অবস্থা এমন হয়ে গেছে তেমন কেউ আর থাকতে পারেন না। কেউ কেউ খুপড়ি ঘরে আছে, কেউ টিন উড়ে যাওয়া ঘরে কোনো মতে আছেন। ঘরগুলো হস্তান্তরের সময় বলা হয়েছিল, যে ঘরে টিন নেই সেগুলো মেরামত করে দেওয়া হবে। কিন্তু এখনো মেরামত করা হয়নি। এমনকি কেউ দেখতেও আসেনি আমরা কেমন করে আছি। আমদের পানি খাওয়ার জন্য ৫টি টিউবওয়েল দেওয়া হয়। তার মধ্যে ২টি নষ্ট হয়ে গেছে।'

তিনি বলেন, 'ঝড়ে ঘরগুলোর টিন উড়ে যাওয়ার পর আমরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে গিয়ে কান্নাকাটি করেছি। কিন্তু আমাদের কথার কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিছুদিন আগে ঝড়ে ঘরের অ্যাঙ্গেল পড়ে আমার বাচ্চাটা মারাই যেত। অল্পতে বেঁচে গেছে। ভাঙা ঘরে আমরা এখন টানাটুনা দিয়ে আছি। কেউ কেউ আবার একটু ঝড় হলে টিনের ফ্রেমে দড়ি বেঁধে ঝুলে থাকে যাতে উড়ে না যায়। ঝড় আসলে কেউ কেউ আবার পাশে একটি গোয়াল ঘরে গিয়ে থাকেন।'
স্বামী হারানো রাশেদা বেগম (৪৫) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাকে সাহায্য করবে এমন কেউ নেই। ঘরগুলো মেরামত করার জন্য ইউএনও অফিসে গেলে আমাদের একটি করে কম্বল দেওয়া হয়। ঘরগুলো মেরামতের আশ্বাস দিয়ে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে কেউ কোনো খবর নেননি। ঘর বরাদ্দ পাওয়ার সময় অনেক খুশি হয়েছিলাম। এমন দুর্দশা হবে জানলে এখানে আসতাম না।'

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ পাওয়া প্রতাপ চন্দ্র দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার নামে যে ঘর বরাদ্দ ছিল সেটির টিন আমাকে হস্তান্তর করার আগেই উড়ে যায়। হস্তান্তর করার সময় আমাকে বলা হয়েছিল, মেরামত করে দেওয়া হবে। ফাঁকা ঘরে তো আর থাকা যায় না। তাই আমি ঘরে উঠিনি। অন্যের জায়গায় ঘর করে আছি। ঘরগুলো মেরামত করে দিলে তারপর উঠবো এই আশায় আছি।'
মো. আসাদুল অভিযোগ করে বলেন, 'ঘরগুলো মেরামতের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউএনও অফিস ঘুরেও কোনো ফল পাইনি। ইউএনও অফিস আমাদের কথার তেমন গুরুত্ব না দিয়ে খোলাহাটি সেনানিবাসে যেতে বলেন। গত ১২ জানুয়ারি খোলাহাটি সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার বরাবর একটি আবেদনপত্র দেই। পরে খোলাহাটি সেনানিবাসে থেকে আমাদের রংপুর সেনানিবাসে যেতে বলে।'
তিনি বলেন, 'আমরা গরিব মানুষ। সবাই দিনমজুর। আমাদের টাকা থাকলে তো নিজেরাই ঘরগুলো ঠিক করে নিতাম। রংপুরে যাওয়ার টাকা আমাদের নেই। তাই আর যাওয়া হয়নি। আমরা অনেক হয়রানির শিকার হচ্ছি। আমাদের কেউ যদি একটু সাহায্য করে খুবই উপকৃত হই।'
খোলাহাটি সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার বরাবর দেওয়া আবেদনপত্রের একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।

দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে দায়িত্বরত খোলাহাটি স্টেশন কমান্ডারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সেনাবাহিনীর যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা রংপুরে বদলি হয়ে গেছেন। সেখানে যোগাযোগ করতে পারেন।
ঘরগুলো নির্মাণের সময় তদারকির দায়িত্বে ছিলেন রংপুর সেনানিবাসের ২৫ বীর সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার মো. মাইনুদ্দিন। দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
তিনি বলেন, 'আমি ঘরগুলো প্রস্তুত করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। তখন ঘরের কোনো সমস্যা ছিল না। ঠিকাদার কিছুটা অনিয়ম করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমি সেই সুযোগ দেইনি। সবকাজ ভালোভাবে করিয়ে নিয়েছি।'
ঘরগুলোর টিন উড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি শুনেছি সেখানে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল তাই উড়ে গেছে। তা ছাড়া ঘরগুলো ফাঁকা জায়গায় করায় বাতাস অনেক বেশি লাগে। এটাও একটা কারণ হতে পারে। তবে এতদিন তো ঘরগুলো ওভাবে পড়ে থাকার কথা নয়। স্থানীয় প্রশাসন চাইলেই এগুলো মেরামত করে দিতে পারতো। তাদের সদিচ্ছার অভাবের কারণেই মেরামত হচ্ছে না।'
ঠিকাদারের পক্ষ থেকে নিয়োজিত ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা তরিকুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত কিছু জানি না। আমাকে ঠিকাদার যেভাবে কাজ করতে বলেছেন আমি সেভাবেই কাজ করেছি। আপনি ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।'
এর আগে সেনা কর্মকর্তা মো. মাইনুদ্দিনও ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তরিকুল ও মাইনুদ্দিনের কাছে পাওয়া ঠিকাদারের ২টি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে বিরল উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াজেদ টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি শুনেছি বিশ্বনাথপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোর টিন ঝড়ের কারণে উড়ে গেছে। এ কারণে অনেকেই ঘরগুলোতে থাকতে পারেন না। আমাকে ফাইল দেখে বলতে হবে ঘরগুলোর মেরামত কোন পর্যায়ে আছে। তা ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বর্তমানে ছুটিতে আছেন। আগামী ১ তারিখে তিনি যোগদান করবেন। তারপর বিস্তারিত বলা যাবে।'
ঘর বরাদ্দ পাওয়াদের খোলাহাটি সেনানিবাসে যেতে বলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এই মানুষগুলোর আসলে সেনানিবাসে যাওয়া সম্ভব না। আমি সজ্ঞানে তাদের সেনানিবাসে যেতে বলনি। হয়তো বা অন্য কেউ বলতে পারেন। অবশ্যই এতে করে তাদের ভোগান্তি হচ্ছে। আমি ফাইলে দেখি কী অবস্থা এখন। আমাদের পক্ষ থেকে কী কী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বা কী কী করার সুযোগ আছে আমি দেখছি বিষয়টি।'
Comments